
ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে গত এক সপ্তাহে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো জনমনে গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত, দেশের বাণিজ্য, শিল্প ও প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলোতে ঘটে যাওয়া এসব আগুনের ঘটনায় শুধু প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতিই নয়, বরং দেশীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সম্ভাব্য নাশকতার আশঙ্কাও সামনে এসেছে। একের পর এক এসব দুর্ঘটনা নিছক কাকতালীয় নয়, বরং অনেকেই মনে করছেন—এর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার একটি পরিকল্পিত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র।
১৪ অক্টোবর দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়ি এলাকার একটি কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ আগুন লাগে। ভবনের ভেতরে থাকা অন্তত ১৬ জন আগুনে পুড়ে মারা যান। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, ভবনের ছাদে টিনশেড ও তালাবদ্ধ দরজার কারণে কেউ বের হতে পারেনি। গুদামে রাখা ছিল হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, ব্লিচিং পাউডার, অ্যাসিড ও দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ, যা আগুনের তীব্রতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে একটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়, পরে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে গিয়ে আগুন মুহূর্তেই গোটা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট প্রায় ছয় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে ততক্ষণে পুরো ভবনটি ধসে পড়ে এবং পার্শ্ববর্তী কয়েকটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনায় সরকারিভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তবে স্থানীয়দের দাবি—গুদামটি অবৈধভাবে আবাসিক এলাকায় পরিচালিত হচ্ছিল, যা বছরের পর বছর প্রশাসনের চোখের সামনে থেকে রেহাই পেয়েছে।
১৬ অক্টোবর দুপুরে চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) ‘অ্যাডামস ক্যাপ’ নামে একটি পোশাক কারখানায় আগুন লাগে। হাসপাতালের পোশাক ও তোয়ালে উৎপাদনের এ কারখানার নিচের দুই তলায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে দাউ দাউ করে জ্বলে। দাহ্য কাঁচামাল থাকায় আগুনের তীব্রতা বাড়ে, এবং রাতের মধ্যেই ভবনের টপ ফ্লোরের ছাদ ধসে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগুন লাগার উৎস ছিল একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ, তবে নাশকতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
কারখানার শ্রমিকরা দাবি করেছেন, ফায়ার অ্যালার্ম ও ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম অকেজো ছিল। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, জরুরি বহির্গমন পথ বন্ধ থাকায় শতাধিক শ্রমিক প্রাণ নিয়ে পালাতে পারেনি। এই ঘটনায় দেশের পোশাক শিল্পের নিরাপত্তা মান নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক অগ্নিকাণ্ডটি ঘটে ১৮ অক্টোবর। দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের ৮ নম্বর গেটে হঠাৎ ধোঁয়া দেখা যায়। মুহূর্তেই তা ভয়াবহ আগুনে রূপ নেয়, যা ছড়িয়ে পড়ে পুরো কার্গো এলাকাজুড়ে। প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, তবে পুরোপুরি নেভাতে সময় লাগে ২৭ ঘণ্টা।
এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক কুরিয়ার পণ্য, ওষুধশিল্পের কাঁচামাল, কৃষিপণ্য, তৈরি পোশাকের রপ্তানি চালানসহ বিপুল পরিমাণ পণ্য পুড়ে যায়। ব্যবসায়ীদের প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, ক্ষতির পরিমাণ ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএইএবি) সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, “এই আগুনে পুরো এয়ার এক্সপ্রেস ইউনিট পুড়ে গেছে। এর ক্ষয়ক্ষতি বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হবে।”
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান মনে করেন, “কার্গো ভিলেজের অভ্যন্তরীণ কোনো চক্র ও বাহ্যিক স্বার্থগোষ্ঠীর যৌথ মদদে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। পণ্য চুরি বা দুর্নীতির প্রমাণ গোপন করতেই হয়তো আগুন লাগানো হয়েছে।”
বিমানবন্দরের মতো কৌশলগত স্থাপনায় এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বড় ধাক্কা খেয়েছে। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো শিরোনাম করেছে “Bangladesh Airport Fire Halts Exports” বা “Massive Blaze at Dhaka Cargo Village Disrupts Trade”।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর টিআইএম নুরুল কবির বলেন, “ফায়ার সেফটির এমন অব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন দ্বিধায় পড়বেন—দেশটি নিরাপদ কি না।”
অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবিরের মতে, “শাহজালালের অগ্নিকাণ্ড শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, বরং বাংলাদেশের প্রশাসনিক দক্ষতা ও সংকট মোকাবিলার সক্ষমতার এক কঠিন পরীক্ষা। দেশের ব্র্যান্ড ইমেজ এখন বড় ঝুঁকিতে।”
ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন দাবি করেছে, ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডগুলো কাকতালীয় নয়—এটি পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিপর্যস্ত করার ষড়যন্ত্র হতে পারে। তাদের মতে, “এভাবে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন লাগা জাতীয় অর্থনীতিকে অচল করার একটি নীলনকশার অংশ।”
একই সঙ্গে বিকেএমইএ ও এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “বিদেশি ক্রেতারা এখন প্রশ্ন তুলবেন—বাংলাদেশের কার্গো সুবিধা নিরাপদ কি না। এটি আমাদের রপ্তানির ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করবে।”
রাজনৈতিক অঙ্গনেও অগ্নিকাণ্ডের এই ধারা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, “দেশজুড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এটি জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার প্রমাণ।”
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “মিরপুর, চট্টগ্রাম ও শাহজালালের অগ্নিকাণ্ড কাকতালীয় নয়। প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা ব্যর্থতার দায় এড়ানো যাবে না।”
এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরকার গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। প্রতিটি ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা হচ্ছে। যদি কোনো নাশকতা বা পরিকল্পিত অগ্নিসংযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়, সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে।”
সরকার এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারীর নেতৃত্বে একটি ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে, যা কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে সৃষ্ট সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করবে।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “এগুলোকে নিছক দুর্ঘটনা ধরে নেওয়া বিপজ্জনক হবে। পরপর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন লাগা একটি প্যাটার্ন তৈরি করছে, যা নাশকতার ইঙ্গিত দেয়। তদন্ত বিলম্ব হলে অপরাধীরা আরও সুযোগ পাবে।”
ফায়ার ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) এ. কে. এম. শাকিল নেওয়াজ বলেন, “বিমানবন্দরের ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম অকেজো ছিল। এটি দায়িত্বে অবহেলার জ্বলন্ত উদাহরণ। নিরাপত্তা মানদণ্ডে ঘাটতি থাকলে এই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটবেই।”
তিনি আরও বলেন, “শুধু ফায়ার সার্ভিস নয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের নিরাপত্তা সক্ষমতা জোরদার করতে হবে। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে আইন, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।”
অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির পরামর্শ দেন, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও দুর্যোগ বিজ্ঞানীদের সম্পৃক্ত করতে হবে, যাতে বাস্তবভিত্তিক হিসাব পাওয়া যায় এবং ভবিষ্যতের প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও কার্যকর হয়।
এক সপ্তাহে মিরপুর, চট্টগ্রাম ও শাহজালালে ঘটে যাওয়া তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুধু আর্থিক বিপর্যয় নয়, বরং দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও বিনিয়োগ আস্থার ওপর বড় আঘাত হেনেছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার একটি ষড়যন্ত্রও হতে পারে।
সরকারি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছু বলা না গেলেও একটি বিষয় স্পষ্ট—বাংলাদেশ এখন এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি: এই আগুনগুলো কি কেবল দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে রয়েছে সুপরিকল্পিত কোনো নাশকতার ছক?
যেভাবেই হোক, এই ঘটনাগুলো দেশকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে—নিরাপত্তা, সুশাসন ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার জায়গায় কোথায় ঘাটতি রয়ে গেছে, এবং ভবিষ্যতে কীভাবে তা রোধ করা যায়। কারণ, প্রতিটি আগুন শুধু ধোঁয়া নয়—তা দেশের ভাবমূর্তিতে কালো দাগ এঁকে যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ