
ছবি: সংগৃহীত
আবারও ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে ফিরে আসছে ভারত-পাকিস্তানের সেই চিরচেনা উত্তেজনা। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বন্ধ থাকলেও, আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলো যেন কখনোই এই দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়—হংকংয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জনপ্রিয় হংকং সিক্সেস টুর্নামেন্টে একই গ্রুপে রাখা হয়েছে দুই প্রতিবেশী ক্রিকেট পরাশক্তিকে। অন্যদিকে বাংলাদেশও পড়েছে তুলনামূলক শক্তিশালী একটি গ্রুপে, যেখানে প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা ও স্বাগতিক হংকং।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানকে রাখা হয়েছে ‘সি’ গ্রুপে, যেখানে তাদের সঙ্গে রয়েছে কুয়েত। টুর্নামেন্টের সূচি অনুযায়ী, দুই দলের মহারণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৯ নভেম্বর হংকংয়ের বিখ্যাত টিন কোয়াং রোড রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে।
এই ম্যাচকে ঘিরে ইতিমধ্যেই ক্রিকেটবিশ্বে তৈরি হয়েছে তুমুল আলোচনা। সর্বশেষ এশিয়া কাপে ভারত-পাকিস্তান তিনবার মুখোমুখি হয়েছিল, প্রতিটি ম্যাচেই টানটান উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। এবার ছোট ফরম্যাটের এই সিক্সেস টুর্নামেন্টেও দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে নতুন রোমাঞ্চ ছড়াবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
ভারতের হয়ে দলকে নেতৃত্ব দেবেন অভিজ্ঞ উইকেটরক্ষক-ব্যাটার দিনেশ কার্তিক, যিনি আইপিএল ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার ফিনিশার ভূমিকায় পরিচিত। তার সঙ্গে থাকবেন দেশটির অন্যতম অভিজ্ঞ স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন, যিনি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তার বৈচিত্র্যময় বোলিংয়ে এখনও বিশ্বসেরা হিসেবে বিবেচিত।
অন্যদিকে পাকিস্তান দলকে নেতৃত্ব দেবেন তরুণ পেসার আব্বাস আফ্রিদি। পাকিস্তানের এই দলেও থাকবেন সাবেক তারকা ক্রিকেটারদের পাশাপাশি কিছু বর্তমান খেলোয়াড়, যারা দেশটির টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে আসছেন।
২০২৫ সালের ৭ থেকে ৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে এবারের হংকং সিক্সেস টুর্নামেন্ট। তিন দিনব্যাপী এই সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের আসরে অংশ নিচ্ছে ১২টি দল, যেগুলোকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে।
গ্রুপ এ: আফগানিস্তান, নেপাল, দক্ষিণ আফ্রিকা
গ্রুপ বি: অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত
গ্রুপ সি: ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত
গ্রুপ ডি: বাংলাদেশ, হংকং, শ্রীলঙ্কা
প্রতিটি গ্রুপ থেকে শীর্ষ দুটি দল কোয়ার্টার ফাইনালে উঠবে।
বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে ‘ডি’ গ্রুপে, যেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে রয়েছে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা এবং স্বাগতিক হংকং। বাংলাদেশ দলটির নেতৃত্বে থাকবেন দেশের সাবেক টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম অথবা সাব্বির রহমান—এমনটাই ক্রিকেটপাড়ার আলোচনায় জানা যাচ্ছে, যদিও এখনো অফিসিয়ালি দল ঘোষণা করা হয়নি।
বাংলাদেশের জন্য এটি হবে এক ধরনের পুনর্বাসনের সুযোগ। কারণ, এশিয়া কাপ এবং সাম্প্রতিক সিরিজগুলিতে ব্যর্থতার পর এই ফরম্যাটে নিজেদের আগ্রাসী খেলার ধাঁচে ফেরার সুযোগ পাবে টাইগাররা। বিশেষ করে ছোট মাঠে এবং দ্রুতগামী ম্যাচ ফরম্যাটে বাংলাদেশের তরুণ ব্যাটাররা যেমন তৌহিদ হৃদয়, আফিফ হোসেন বা নাঈম শেখ ভালো পারফর্ম করতে পারেন বলে মনে করছেন ক্রিকেট বিশ্লেষকেরা।
হংকং সিক্সেস ক্রিকেটের অন্যতম সংক্ষিপ্ত ও দ্রুততম সংস্করণ। এখানে প্রতিটি দলে থাকে মাত্র ৬ জন ক্রিকেটার, এবং প্রতিটি ম্যাচ হয় ৫ ওভারের (প্রতি ইনিংস) মধ্যে। উইকেটরক্ষক ছাড়া দলের বাকি পাঁচজনকে অবশ্যই বল করতে হয়। একজন বোলার সর্বোচ্চ ২ ওভার করতে পারবেন।
বাউন্ডারি ছোট হওয়ায়, ব্যাটাররা সাধারণত শুরু থেকেই মারমুখী খেলায় নামেন। এই ফরম্যাটে বোলারদের জন্য চ্যালেঞ্জ যেমন বেশি, দর্শকদের জন্য বিনোদনও ততটাই। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি ম্যাচ শেষ হয়ে যায়, যা টি-টোয়েন্টির চেয়েও বেশি উত্তেজনাপূর্ণ।
হংকং সিক্সেস ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সূচনা হয় ১৯৯২ সালে। এটি এশিয়ার অন্যতম বিনোদনমূলক ক্রিকেট আয়োজন হিসেবে পরিচিত। বছরজুড়ে বিভিন্ন দেশ থেকে সাবেক তারকা ও বর্তমান ক্রিকেটাররা এতে অংশ নেন। গত আসরের চ্যাম্পিয়ন ছিল শ্রীলঙ্কা, যারা দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারায়।
বাংলাদেশ এই টুর্নামেন্টে সর্বশেষ অংশ নিয়েছিল ২০১৮ সালে। সেবার দলটি কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিদায় নেয়। এবার নতুন করে দল গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেদের শক্তিমত্তা দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে।
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই আসরে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচই হবে মূল আকর্ষণ। মাত্র ৫ ওভারের খেলায় যেখানে প্রতিটি বলেই ম্যাচ ঘুরে যেতে পারে, সেখানে দুই দলের আক্রমণাত্মক মনোভাবের কারণে ম্যাচটি হতে পারে উচ্চ রানের।
ক্রিকেট বিশ্লেষক হার্শা ভোগলে মন্তব্য করেছেন, “সিক্সেস ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান মানে হলো মুহূর্তের আবেগ, স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক আর বিস্ফোরক শটের বন্যা। এই ম্যাচই পুরো টুর্নামেন্টের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে।”
অন্যদিকে বাংলাদেশের গ্রুপও কম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নয়। শ্রীলঙ্কা বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আসরে নামছে, আর স্বাগতিক হংকংও ছোট ফরম্যাটে যথেষ্ট শক্তিশালী দল।
বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার খালেদ মাহমুদ সুজন বলেন, “এমন টুর্নামেন্ট তরুণদের জন্য দারুণ সুযোগ। এখানকার দ্রুত খেলার অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও কাজে লাগে। আশা করছি বাংলাদেশ দল অন্তত সেমিফাইনাল পর্যন্ত যাবে।”
তিন দিনের এই আসরে অনুষ্ঠিত হবে মোট ২৯টি ম্যাচ। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একাধিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে টিন কোয়াং রোড রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে। ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে ৯ নভেম্বর রাতে, ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচের পর।
হংকং ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, দর্শকদের অভূতপূর্ব আগ্রহের কারণে টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় সব টিকিট শেষ হয়ে গেছে। আয়োজকেরা এবার আন্তর্জাতিক সম্প্রচারও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে সারা বিশ্বের দর্শক অনলাইনে ম্যাচগুলো দেখতে পারেন।
ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান মানেই আবেগ, উত্তেজনা আর সীমাহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আর হংকং সিক্সেসের মতো দ্রুতগামী, বিনোদনমূলক ফরম্যাটে এই দুই দল একসঙ্গে পড়ায় ক্রিকেটবিশ্বে উত্তাপ ছড়িয়েছে আগেভাগেই।
বাংলাদেশের জন্যও এটি এক বিশেষ সুযোগ—নিজেদের খেলার ছন্দে ফেরার, তরুণদের আত্মপ্রকাশের। ৭ থেকে ৯ নভেম্বরের এই তিন দিন তাই হয়ে উঠবে ক্রিকেট উৎসবের, যেখানে রঙ ছড়াবে ব্যাট-বলের ঝড়, ছক্কার বৃষ্টি, আর পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন রূপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ