ছবি: সংগৃহীত
অর্থনৈতিক ধাক্কা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের মধ্যেও দেশের প্রবাসীরা আবারও দেখালেন তাদের অদম্য দেশপ্রেমের উদাহরণ। চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম ২২ দিনেই প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে ১৯২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৩ হাজার ৪৩৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসেবে)। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে দেশে এসেছে ৮৭০ কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, “রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সরকারি প্রণোদনা, হুন্ডি দমন কার্যক্রম এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর প্রবাসী আয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২০২৪ সালের অক্টোবরের প্রথম ২১ দিনে এসেছিল ১৭৯ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার, আর চলতি বছর সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার—অর্থাৎ, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি শুধু সংখ্যার বৃদ্ধি নয়, বরং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে ডলারের সরবরাহ বাড়ার ফলে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার আশা করছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হাফিজ বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতির অক্সিজেন হলো প্রবাসী আয়। এমন সময়ে রেমিট্যান্স বাড়া অত্যন্ত ইতিবাচক খবর। এটি মুদ্রা বিনিময় হার ও বৈদেশিক বাণিজ্যে চাপ কিছুটা লাঘব করবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২৬) শুরু থেকে মাত্র ১ জুলাই থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রবাসী আয় এসেছে ৯৫০ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে এই আয় ছিল ৮৩৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্সে বেড়েছে ১১৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরের শেষে প্রবাসী আয়ের অঙ্ক ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা হবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম রেকর্ড অর্জন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার উৎসাহিত করতে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া হুন্ডি রোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযানও অনানুষ্ঠানিক পথে অর্থ পাঠানো কমিয়ে আনছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, “সরকারি প্রণোদনা ছাড়াও বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক প্রবাসীদের জন্য মোবাইল অ্যাপে টাকা পাঠানোর দ্রুত সেবা দিচ্ছে। ফলে মানুষ এখন অনেক সহজেই আইনসম্মত পথে টাকা পাঠাতে পারছে।”
রেমিট্যান্স প্রেরণকারী ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো—বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও ওমান থেকে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসছে। এর পাশাপাশি মালয়েশিয়া ও ইতালি থেকেও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয় অন্যতম প্রধান ভিত্তি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রায় ৬০ শতাংশই আসে রেমিট্যান্স থেকে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে থাকা অর্থনীতিতে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করছে।
এ ছাড়া প্রবাসী আয় সরাসরি প্রভাব ফেলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দিয়ে পরিবারগুলো নতুন ঘর তৈরি করছে, জমি কিনছে, ব্যবসা শুরু করছে এবং সন্তানদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে। ফলে প্রবাসী আয়ের প্রভাব শুধু জাতীয় অর্থনীতিতেই নয়, বরং সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মো. মুশাররফ হোসেন বলেন, “রেমিট্যান্স বাড়ার মানে শুধু ডলার প্রবাহ বৃদ্ধি নয়—এটি দেশের ভোক্তা ব্যয়, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে গ্রামীণ বাজারে এর প্রভাব সবচেয়ে দৃশ্যমান।”
যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে, তবে এর স্থায়িত্ব নিয়ে উদ্বেগও আছে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা, অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধি ও হুন্ডি চক্রের সক্রিয়তা এই খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাই প্রবাসীরা যেন আইনসম্মত পথে টাকা পাঠান। এজন্য ব্যাংকগুলোর সেবার মান আরও উন্নত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে সরকারি প্রশিক্ষণ প্রকল্পগুলোকেও আরও জোরদার করতে হবে।”
-
২২ দিনে রেমিট্যান্স: ১৯২.১০ কোটি ডলার (২৩,৪৩৬ কোটি টাকা)
-
গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি: ৭.৩০%
-
চলতি অর্থবছরের (১ জুলাই–২২ অক্টোবর) মোট আয়: ৯৫০.৭০ কোটি ডলার
-
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি: ১৪.১০%
-
সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে: সৌদি আরব, ইউএই, কাতার, ওমান থেকে
সব মিলিয়ে, অক্টোবর মাসের এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন, মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে আবারও প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, “প্রবাসীরা আসলেই আমাদের অর্থনীতির নীরব নায়ক—তাঁদের পাঠানো প্রতিটি ডলারই দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে ভূমিকা রাখছে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



