ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের তিন দিন পার হলেও এখনো স্বাভাবিক হয়নি পণ্য খালাস কার্যক্রম। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন শত শত আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী। ক্ষতিগ্রস্ত গুদাম ও বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কার্গো ইউনিটের কার্যক্রম এখনো অচলাবস্থায়। আমদানি করা মালামাল হাতে পেতে ব্যবসায়ীদের ঘুরতে হচ্ছে একাধিক দপ্তর, গেট ও কর্মকর্তার কাছে। শৃঙ্খলা দ্রুত না ফিরলে কার্গো এলাকায় পণ্যের বড় জট সৃষ্টি হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিমানবন্দরের নয় নম্বর গেট এখন ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কেন্দ্রবিন্দু। পণ্য খালাসের একমাত্র গেট এটি। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এই গেটের সামনে ভিড় জমাচ্ছেন শত শত ব্যবসায়ী ও ক্লিয়ারিং-ফরওয়ার্ডিং (সিএন্ডএফ) এজেন্ট। অগ্নিকাণ্ডের পর নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রবেশ ও পণ্য উত্তোলন প্রক্রিয়া কঠোর করা হয়েছে। এর ফলে উড়োজাহাজ থেকে নামানো মালামাল শনাক্ত করা ও খালাসের অনুমতি পাওয়া এখন সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একজন আমদানিকারক জানান, “আমাদের পণ্যগুলো সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে, কিন্তু তিন দিন ধরে কোনোভাবে তা হাতে পাচ্ছি না। কর্তৃপক্ষ বলছে, অগ্নিকাণ্ডের কারণে ডকুমেন্টেশন এবং মালামাল যাচাইয়ে দেরি হচ্ছে। এতে আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে প্রতিদিন।”
কার্গো ভিলেজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বর্তমানে উদ্ধার হওয়া মালামাল শনাক্ত করে দ্রুত খালাসে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে মালামাল বুঝে দেওয়া ও গ্রহণের কাজে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বিশাল অংশ এখনো নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে। ফলে অফিস, গুদাম ও পরিবহন কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চলছে। যেসব পণ্য অক্ষত আছে, সেগুলোও শনাক্ত করতে সময় লাগছে।
একজন কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত সম্ভব অক্ষত মালামালগুলো হস্তান্তর করা যায়। কিন্তু গুদামের অর্ধেক অংশ পুড়ে যাওয়ায় ফাইল, ট্যাগ ও নথিপত্রের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এখন সবকিছু হাতে হাতে মিলিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, এতে সময় বেশি লাগছে।”
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে কাজ শুরু করেছে। বেসামরিক বিমান ও পর্যটন উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার অস্থায়ীভাবে প্রস্তুত করা কার্গো ভিলেজ এলাকা পরিদর্শন করেন। তবে গেটের বাইরে অপেক্ষমাণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তিনি কথা বলেননি, যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক ভুক্তভোগী।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা ও নির্দেশনার অভাবে পুরো কার্যক্রমে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে। কেউ জানে না কার কাছে যেতে হবে, কীভাবে মালামাল শনাক্ত করা হবে, কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের শুল্ক ফেরতের প্রক্রিয়া কী হবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক সদস্য বলেন, “যত দিন পণ্য খালাসে এই বিশৃঙ্খলা থাকবে, তত দিন ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। প্রতিদিন পণ্য আটকে থাকায় আমদানিকারকদের গুদাম ভাড়া, ব্যাংক সুদ, এবং ক্লায়েন্ট ডেলিভারিতে বিলম্বজনিত জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে।”
অন্যদিকে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, অগ্নিকাণ্ডের কারণে কিছু স্থাপনা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অস্থায়ী কার্গো ভিলেজ স্থাপন করে জরুরি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে অক্ষত পণ্য শনাক্ত করে খালাস শুরু হয়েছে, তবে পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরতে আরও কয়েক দিন লাগতে পারে।
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি কাজ করছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলেছে, দ্রুত পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে পণ্য খালাসের কার্যক্রম স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। নিরাপত্তা ও শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়গুলোও একযোগে দেখা হচ্ছে।
অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া গুদামের একাংশে মূল্যবান ইলেকট্রনিকস, মোবাইল, পোশাক, ওষুধ, এবং পার্সেল পণ্য ছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ক্ষতির পরিমাণ কয়েক শত কোটি টাকারও বেশি। তবে সঠিক হিসাব প্রকাশ করতে আরও কিছু সময় লাগবে বলে জানানো হয়েছে।
এদিকে, ব্যবসায়ীরা দাবি তুলেছেন—সরকারকে দ্রুত অস্থায়ী সমাধানের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার পরিকল্পনা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড বা ব্যবস্থাপনা বিপর্যয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ না হয়।
অগ্নিকাণ্ডের তিন দিন পরও বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ যেন এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে—খালাসে নেই শৃঙ্খলা, নেই নির্দেশনার স্বচ্ছতা। প্রতিদিন বাড়ছে অপেক্ষমাণ ব্যবসায়ীর সংখ্যা, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গভীর হচ্ছে তাদের উদ্বেগ ও ক্ষতির হিসাব।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



