ছবি: সংগৃহীত
মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সাদা পোশাকের বাইরে দীর্ঘ সময় ধরে থমকে থাকা আনন্দ অবশেষে ফিরে এল রঙিন পোশাকে। বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ওয়ানডে সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৭৯ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। এই জয়ে শুধু এক ম্যাচ নয়, পুনরুদ্ধার হলো আত্মবিশ্বাস, ঘুচল চার ম্যাচের হারের বেদনা, আর ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখে ফিরল সেই পুরোনো হাসি।
যে ম্যাচে সবাই ভেবেছিল ‘লো-স্কোরিং’ এক লড়াই হবে, সেটি পরিণত হলো ব্যাট-বল-ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশের একচেটিয়া প্রদর্শনীতে। ম্যাচ শুরুর আগে টিভি কমেন্ট্রিতে শ্রীলঙ্কার সাবেক ক্রিকেটার ফারভিজ মাহরুফ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন—“এ উইকেটে ২৫০ পার করাও কঠিন হবে।” কিন্তু ম্যাচ শেষে সেই মাহরুফকেই সহকর্মীদের ঠাট্টার শিকার হতে হলো, কারণ বাংলাদেশের ব্যাটাররা এই উইকেটকেই পরিণত করেছেন ব্যাটসম্যানদের স্বর্গে।
অন্যদিকে বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম ছুটি কাটিয়ে আগের দিন রাতে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরে সকালে মাঠে এসে অবাক, “আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না, এমন উইকেট কোথা থেকে এল!”
যে উইকেটে আগের ম্যাচে বল নিচু হচ্ছিল, সেই একই জায়গায় এবার ব্যাটে-বলে দারুণ বাউন্স ও গতি। এদিন বাংলাদেশের দুই ওপেনার সাইফ হাসান ও সৌম্য সরকার এমনভাবে রানের স্রোত বইয়ে দেন যে, ২৫ ওভারে দলীয় সংগ্রহ পৌঁছে যায় ১৭৬-এ!
টস জিতে প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশ। অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ ম্যাচের শুরুতেই জানান, “২৪০ রান হলে জেতার মতো স্কোর হবে।” কিন্তু ওপেনিং জুটিতে যা হলো, তা সেই প্রত্যাশার বহু গুণ ছাড়িয়ে যায়। সাইফ-সৌম্যের ব্যাটে প্রথম ১০ ওভারে আসে ৭৪ রান—যা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জন্য বিরল ঘটনা। বল ব্যাটে আসছিল দারুণভাবে, দুই ওপেনার খেলছিলেন চোখ-ধাঁধানো শট।
স্পিনারদের বিরুদ্ধে রিভার্স সুইপ, ফ্রন্ট ফুটে ড্রাইভ, ব্যাকফুটে কাট—সবই দেখা গেল এই জুটির ব্যাটে। একপর্যায়ে ক্যারিবীয় অধিনায়ক শাই হোপ বাধ্য হন ১০ম ওভারেই পেসার জাস্টিন গ্রেভসকে আক্রমণে আনতে। কিন্তু বাংলাদেশের ওপেনারদের তাণ্ডব তখনও থামেনি।
সাইফ ৭২ বলে ৮০ রান করেন ৬ ছক্কা ও ৬ চার মেরে। আর সৌম্য ৮৬ বলে ৯১ রান করেন ৪ ছক্কা ও ৭ চার মেরে। দুজনেই শতরান ছোঁয়ার আগে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে আউট হন, কিন্তু ততক্ষণে দল পেয়ে গেছে বিশাল ভিত্তি। তাদের ১৭৬ রানের জুটি ৪৫ ওয়ানডে পর বাংলাদেশের প্রথম শতরানের উদ্বোধনী জুটি।
যদিও এই দুর্দান্ত সূচনার পর বাংলাদেশ কিছুটা হোঁচট খায়। পরের ২৫ ওভারে যোগ হয় মাত্র ১২০ রান, পড়ে ৮ উইকেট। তবে আগের ইনিংসের রানের পাহাড়ই যথেষ্ট হয়ে ওঠে। নাজমুল হোসেন শান্ত ৫৫ বলে ৪৪ রান করেন, কিন্তু অন্যরা টিকতে পারেননি।
ক্যারিবীয় স্পিনার আকিল হোসেন একাই নেন ৪ উইকেট ৪১ রানে। তাঁর এক ওভারেই পড়ে তিন উইকেট, যার মধ্যে ছিল মাহমুদউল্লাহ, আফিফ ও মিরাজের উইকেট। ক্যারিবীয়রা একাধিক সহজ ক্যাচ ও স্টাম্পিংয়ের সুযোগ নষ্ট না করলে বাংলাদেশের ইনিংস হয়তো আরও আগেই শেষ হয়ে যেত।
তবুও ইনিংসের শেষভাগে রিশাদ হোসেন ও শরিফুল ইসলামের কিছু মূল্যবান রান দলকে পৌঁছে দেয় ২৯৬ রানে—যা পরবর্তীতে বিশাল জয়ের পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়।
২৯৭ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটাররা যেন শুরু থেকেই আত্মসমর্পণ করে বসেন। স্পিনারদের বিপক্ষে খেলতে গিয়ে একে একে সবাই ফাঁদে পড়েন। বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদ প্রথম আঘাত হানেন, ফেরান ওপেনার আলিক অ্যাথানেজ ও আকিম অগাস্টেকে এলবিডব্লিউ করে। এরপর ব্রেন্ডন কিংকে বোল্ড করে ৩৫ রানে ৩ উইকেটের বিপর্যয়ে ফেলে দেন সফরকারীদের।
এরপর বোলিং আক্রমণে যোগ দেন তানভির ইসলাম ও রিশাদ হোসেন। তানভির নেন ২ উইকেট ১৬ রানে, আর রিশাদ ৩ উইকেট ৫৪ রানে। নাসুম শেষ করেন ৩ উইকেট ১১ রানে—যা তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের পুরো দল শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি ২৮ ওভারও। সবশেষে তাদের ইনিংস গুটিয়ে যায় মাত্র ১১৭ রানে।
এই জয়ে বাংলাদেশ পেল ওয়ানডে ইতিহাসে নিজেদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবধানের জয়। সর্বোচ্চ জয়টি এসেছিল ২০২৩ সালে সিলেটে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে—১৮৩ রানে। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৭৯ রানে হারিয়ে সেই রেকর্ডের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গেল মিরাজের দল।
অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ ম্যাচ শেষে বলেন, “দল হিসেবে আমরা একসঙ্গে পারফর্ম করেছি, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাটিংয়ে সাইফ-সৌম্য শুরুটা যেভাবে দিয়েছে, তাতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। পরে স্পিনাররা দুর্দান্ত করেছে।”
মিরপুর গ্যালারিতে ছিল এক উৎসবের আমেজ। দর্শকদের মুখে মুখে ছিল “বাংলাদেশ, বাংলাদেশ” ধ্বনি। চার ও ছক্কার বৃষ্টিতে মাতোয়ারা ছিল সবাই। ম্যাচ শেষে টিম হোটেল পর্যন্ত দলকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির হন অসংখ্য সমর্থক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই জয় শুধু একটি সিরিজ জয় নয়, বরং মানসিক বাধা পেরোনোর এক বড় পদক্ষেপ। ব্যাটিংয়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যর্থতার পর এমন আত্মবিশ্বাসী পারফরম্যান্স দলের জন্য আশার বার্তা।
ম্যাচসেরা নির্বাচিত হন সৌম্য সরকার—৯১ রানের ইনিংসের জন্য। সিরিজসেরা হয়েছেন লেগস্পিনার রিশাদ হোসেন, তিন ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়ে তিনিই ছিলেন ক্যারিবীয়দের আতঙ্ক।
দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন এক উজ্জ্বল দিন—যে দিন ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে সব দিকেই ছড়িয়েছে আত্মবিশ্বাস। এ জয় শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর নয়, বরং নিজেদের ফিরে পাওয়ার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



