ছবি: সংগৃহীত
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রার্থীদের আয়-সম্পদের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবেন, তাদের দেশি ও বিদেশি সব উৎস থেকে অর্জিত আয় ও সম্পত্তির বিস্তারিত বিবরণ নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে। পরবর্তীতে এসব তথ্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলসহ অন্যান্য উপদেষ্টারা।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, আর্থিক জবাবদিহি এবং নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, "জনপ্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব নিতে হলে জনগণের কাছে নিজের আর্থিক অবস্থা ও আয়ের উৎস সম্পর্কে পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন। জনগণ যেন জানতে পারে, তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হতে ইচ্ছুক ব্যক্তির আর্থিক পটভূমি কেমন, সেটি জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।"
প্রধান উপদেষ্টা আরও উল্লেখ করেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বহু প্রার্থী তাদের আয়ের প্রকৃত উৎস ও সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ গোপন করেছেন বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন। এবার সে সুযোগ থাকবে না। ইসি যেন প্রার্থীদের আয়-সম্পদের যাচাই প্রক্রিয়া কঠোরভাবে অনুসরণ করে, সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে প্রার্থীর নাম, পেশা, আয়কর প্রদানের ইতিহাস, দেশি ও বিদেশি সম্পত্তির বিবরণ, শেয়ার বা ব্যবসায়িক মালিকানা এবং ব্যাংক হিসাবের তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে। পাশাপাশি, প্রার্থীর উপর কোনো ঋণ, মামলা, বা দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে তাও সেখানে প্রকাশ করা হবে।
এই পদক্ষেপের ফলে ভোটাররা সহজেই প্রার্থীদের আর্থিক স্বচ্ছতা যাচাই করতে পারবেন এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কাকে ভোট দেবেন। সরকার আশা করছে, এতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে এবং কালো টাকা ও অবৈধ অর্থের প্রভাব কমবে।
বিকেলে রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, প্রার্থীদের সম্পদের তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত বিষয়টি শুধু প্রশাসনিক নির্দেশনা নয়, বরং এটি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নতুন নির্বাচনী আইনে একটি পৃথক ধারা যোগ করা হবে, যেখানে বলা থাকবে—“প্রত্যেক প্রার্থীকে তাঁর দেশি ও বিদেশি উৎসে অর্জিত সকল আয় ও সম্পত্তির বিবরণ নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে হবে এবং তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা চাই, এই নির্বাচন যেন শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু না হয়, বরং নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যও হয়। প্রার্থীরা যদি নিজেদের আর্থিক অবস্থা জনগণের সামনে তুলে ধরেন, তাহলে স্বচ্ছতা ও গণবিশ্বাস দুটোই বাড়বে।”
অতীতে প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও তা কখনোই প্রকাশ্যে আনা হতো না। অনেক সময় প্রার্থীরা সীমিত তথ্য দিতেন, আবার অনেকে সম্পূর্ণ কাল্পনিক তথ্যও জমা দিতেন। নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ নথি ছাড়া সাধারণ জনগণ এসব তথ্য জানতে পারতেন না। এবার সেই প্রথা ভাঙছে অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রধান উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনাও বিবেচনা করছে সরকার। এছাড়া, ইসলামী ব্যাংক বা ইবনে সিনা গ্রুপের মতো বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ না দেওয়ার নীতিও অনুসরণ করা হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হতে পারে। এতে অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছ প্রার্থীদের ওপর চাপ বাড়বে, একই সঙ্গে ভোটারদের আস্থা পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রাখবে।
একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, “যদি এই উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে এটা নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করবে। জনগণ জানবে, তাদের প্রতিনিধিরা কতটা সৎ এবং আর্থিকভাবে কতটা জবাবদিহিমূলক।”
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রযুক্তিগত দিক থেকে ওয়েবসাইটে এমন তথ্য সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই এ সংক্রান্ত খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনঅংশগ্রহণ—এই তিনটি মূলনীতিকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার এই নির্দেশনা বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চায় একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



