ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতে এক অভূতপূর্ব ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। একদিকে শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বাড়ছে আসন সংখ্যা। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে প্রায় ১১ লাখ আসন ফাঁকা থেকে যাবে। এর মূল কারণ, এবার এইচএসসিতে পাশের হার গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হওয়া এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় পরিকল্পনাহীন সম্প্রসারণ।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছর নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও আসন বৃদ্ধির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ বাড়ানো হলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা সে অনুপাতে বাড়ছে না। বরং ফলাফল খারাপ হওয়ায় উচ্চশিক্ষায় যোগ্য শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠান—বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ ও পিছিয়ে পড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো—ন্যূনতম একজন শিক্ষার্থীও পাবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত এক যুগে দেশের উচ্চশিক্ষা খাতে আসন সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। বর্তমানে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ মিলিয়ে অনার্স ও সমমান পর্যায়ে মোট ১৮ লাখ ৭ হাজার ৫৭৬টি আসন রয়েছে।
অন্যদিকে, এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন শিক্ষার্থী, যার মধ্যে পাশ করেছেন মাত্র ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন। অর্থাৎ, পুরো ব্যাচের প্রায় ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। এমনকি যারা পাস করেছেন, তাদের সবাইও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন না—বিভিন্ন কারণে (অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, বিদেশে পড়াশোনা, টেকনিক্যাল শিক্ষা ইত্যাদি)। ফলে বিশাল সংখ্যক আসন ফাঁকা থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন, জিপিএ-৪ পেয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার এবং জিপিএ-৩.৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার শিক্ষার্থী। যদিও অনেকে ভাবেন, জিপিএ-৫ মানেই সাফল্য, বাস্তবে ভর্তি পরীক্ষার ফলই নির্ধারণ করে কে কোথায় ভর্তি হতে পারবেন। গত বছর দেখা গেছে, জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীও ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন।
এবারও সবচেয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা হবে মেডিক্যাল, প্রকৌশল ও শীর্ষ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪০ হাজার আসনের বিপরীতে আবেদন করবে প্রায় ৪ লাখ ৮৪ হাজার শিক্ষার্থী—অর্থাৎ, প্রতিটি আসনের জন্য গড়ে ১২ জন শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতা করবেন।
বর্তমানে দেশে রয়েছে ৩৬টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও পাঁচটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, চুয়েট, শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)। এসব প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার ৫০০। এছাড়া ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়—এই পাঁচটি প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে প্রায় ২২ হাজার আসন।
শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিক্যাল কলেজগুলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীরা সারা বছর কোচিং করে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত বছর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি আসনের জন্য গড়ে ২০ জন পর্যন্ত আবেদন করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “চাহিদা যাচাই ছাড়া এবং পরিকল্পনাহীনভাবে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও আসন বাড়ানোয় এখন এই বিপর্যয়। উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়—এটি তাদের জন্য, যারা সক্ষম, আগ্রহী ও যোগ্য।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের দেশে একধরনের সামাজিক চাপ তৈরি হয়েছে—সবাইকে যেন অনার্স করতে হয়, মাস্টার্স করতে হয়। অথচ এটা যৌক্তিক নয়। কেউ টেকনিক্যাল শিক্ষায় যাবে, কেউ ব্যবসায়, কেউ স্বাধীন পেশায়—এটিই হওয়া উচিত। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু সনদ দেওয়া নয়, শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা।”
যারা শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না, তাদের শেষ ভরসা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে স্নাতক (পাস ও সম্মান) পর্যায়ে ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৯৫টি আসন রয়েছে।
এছাড়া—
ঢাকার সাত সরকারি কলেজে আসন রয়েছে ২৩ হাজার ৬৩০টি,
ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৬৪ হাজার ৫২৯টি,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭ হাজার ৫৯৩টি,
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ইনস্টিটিউটে ৫ হাজার ৬০০টি,
টেক্সটাইল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ১ হাজার ৪৪০টি আসন রয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, “গত বছর থেকে আমরা ভর্তি পরীক্ষা চালু করেছি। এতে মেধাভিত্তিক ভর্তি সম্ভব হয়েছে। আগের মতো কেবল আবেদন করলেই ভর্তি নয়—এখন যোগ্য শিক্ষার্থীই ভর্তি হতে পারছে। এতে মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে।”
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা এখন পরিমাণের দিক থেকে অনেক বড়, কিন্তু মানের দিক থেকে ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, গবেষণা সুযোগ ও শিল্পসংযোগ বাড়ানো ছাড়া উচ্চশিক্ষার এই সম্প্রসারণ দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ আ ফ ম সিদ্দিকী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে চাহিদা, মান, শিক্ষকসংখ্যা ও কর্মসংস্থান বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু আমরা উল্টোটা করছি—আগে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে পরে ভাবছি শিক্ষার্থী পাব কিনা।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম বলেন, “এইচএসসি পাস কমে যাওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহও হ্রাস পাচ্ছে। বেকারত্বের ভয়, কোচিং নির্ভর প্রতিযোগিতা ও ব্যয়বহুল শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করছে।”
শিক্ষাবিদদের মতে, সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়মুখী না করে কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষায় আকৃষ্ট করতে হবে। বর্তমানে দেশের শিল্প খাত দক্ষ শ্রমিক পাচ্ছে না, অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিবছর হাজার হাজার বেকার স্নাতক তৈরি করছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সিন্ডিকেট সদস্য ড. মাহবুব আলম বলেন, “আমাদের অর্থনীতি এখন এমন পর্যায়ে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় সনদ নয়, বাস্তব দক্ষতা জরুরি। তাই কারিগরি শিক্ষা ও ভোকেশনাল ট্রেনিং কেন্দ্রগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।”
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, যদি এখনই উচ্চশিক্ষায় সুষ্ঠু পরিকল্পনা না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী সংকটে পড়ে টিকে থাকতে হিমশিম খাবে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে ভর্তি সংকটে পড়ে বন্ধ হওয়ার মুখে।
তারা বলছেন, “উচ্চশিক্ষা খাতকে এখনই পুনর্বিন্যাস করতে হবে—
১. চাহিদা অনুযায়ী আসন নির্ধারণ,
২. গুণগত মাননির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু,
৩. বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা বাড়ানো,
৪. গবেষণা ও উদ্ভাবনে উৎসাহ প্রদান,
৫. কারিগরি শিক্ষা খাতের সঙ্গে সমন্বয়।”
দেশের উচ্চশিক্ষা আজ একটি সড়কবিভাজনে দাঁড়িয়ে—একদিকে পরিকল্পনাহীন সম্প্রসারণ, অন্যদিকে বাস্তবতা ও সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। তাই শিক্ষাবিদদের ভাষায়, “উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়—যাদের সামর্থ্য ও মেধা আছে, তাদের জন্যই। আর বাকিদের জন্য থাকা উচিত কর্মমুখী বিকল্প পথ।”
এ বছর যে ১১ লাখ আসন ফাঁকা থাকার আশঙ্কা, সেটিই হয়তো দেশের উচ্চশিক্ষা কাঠামো পুনর্বিবেচনার এক কঠিন বার্তা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



