ছবি: সংগৃহীত
দুই দশকেরও বেশি সময় পর আবারও মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। ২০২৫ সালের ২৭ অক্টোবর ঢাকায় বসছে দুই দেশের নবম যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জিইসি) বৈঠক—যা শুধু অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিক দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ এক অধ্যায় হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে।
তবে প্রশ্ন উঠছে—দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা, রাজনৈতিক সন্দেহ-অবিশ্বাস এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে এই বৈঠক কতটা ফলপ্রসূ হবে? দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক কি নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে, নাকি এটি কেবল আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সৌজন্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
২০০৫ সালে শেষবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠক। এরপর রাজনৈতিক টানাপোড়েন, কূটনৈতিক অনীহা ও আঞ্চলিক জটিলতার কারণে এই ফোরামটি কার্যত স্থবির হয়ে যায়। এবার ২০ বছর পর ঢাকায় আয়োজিত নবম জিইসি বৈঠক তাই শুধু একটি অর্থনৈতিক সংলাপ নয়, বরং দুই দেশের সম্পর্ক পুনঃউষ্ণ করার এক সম্ভাবনাময় মঞ্চ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, আর পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন দেশটির পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী আলী পারভেজ মালিক। মূল আলোচনার বিষয় হিসেবে থাকছে—দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ সুরক্ষা, কৃষি, ব্যাংকিং, আর্থিক সেবা, জ্বালানি সহযোগিতা, এবং শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিনিময়। বৈঠক শেষে উভয় দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরের সম্ভাবনাও রয়েছে।
বৈঠকের পরদিন, অর্থাৎ ২৮ অক্টোবর, বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের আমন্ত্রণে ইসলামাবাদ সফরে যাবেন—যেখানে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সহযোগিতা বিষয়ক আলোচনার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্যের ভারসাম্য দীর্ঘদিন ধরেই একমুখী। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তানে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল মাত্র ৮৭ মিলিয়ন ডলার, বিপরীতে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়েছে ৬৭৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ, বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৮৭ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ থেকে মূলত রপ্তানি হয় ওষুধ, পাটজাত পণ্য, সিরামিক, হালকা প্রকৌশল পণ্য ও কিছু কৃষিপণ্য; অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে আসে তুলা, গম, শুঁটকি, কাগজ ও কেমিক্যালজাত দ্রব্য। তবে দুই দেশের পণ্যের ধরণ অনেকাংশেই এক—বিশেষ করে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল ও কৃষিজ পণ্যে—যার কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে উভয় পক্ষই সীমাবদ্ধতায় পড়ছে।
বিআইসিসিআই (Bangladesh International Chamber of Commerce and Industry)-এর পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, “দুই দেশের পণ্যের গঠন প্রায় একই রকম। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয়েই টেক্সটাইল রপ্তানিকারক দেশ, ফলে একে অপরের বাজারে সুবিধা পেতে হলে পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে হবে। শুধু পোশাক নয়, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ ও কৃষিপণ্যের মতো নতুন খাতেও সহযোগিতা বাড়াতে হবে।”
ভৌগোলিকভাবে কাছাকাছি হলেও দুই দেশের মধ্যে সরাসরি স্থল বা সমুদ্রপথের বাণিজ্য কার্যত অনুপস্থিত। ভারতকে এড়িয়ে বিকল্প রুট না থাকায় পণ্য পরিবহন ব্যয় তিনগুণ বেড়ে যায়। একটি কনটেইনার পণ্য করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে সময় লাগে গড়ে ২৫ দিন, যেখানে একই দূরত্বে ইউরোপে রপ্তানি করতে সময় লাগে ১৫ দিনেরও কম।
বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (BFTI) সিনিয়র গবেষক ড. আফসানা তাবাসসুম বলেন, “বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি শিপিং লিংক বা রেল সংযোগ নেই। ট্রানজিট নির্ভর পরিবহনে সময় ও খরচ দুই-ই বাড়ছে। আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি না বাড়ালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ বাস্তবে সম্ভব নয়।”
বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আস্থাহীনতা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রা বিনিময়ের ঝুঁকি ও দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তির অভাবে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের আগে ঐতিহাসিক দেনাপাওনার কিছু ইস্যু নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, “আমাদের মধ্যে এখনো কিছু আর্থিক দেনাপাওনার প্রশ্ন রয়ে গেছে। এগুলো নিরসন না করলে ব্যবসায়িক আস্থা গড়ে উঠবে না। পাশাপাশি কৃষিপণ্য ও খাদ্যপণ্যে পারস্পরিক স্বীকৃতির (Mutual Recognition) চুক্তি করা গেলে বাণিজ্যে বাস্তব অগ্রগতি আসতে পারে।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “এই বৈঠক শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক পুনরায় উষ্ণতা তৈরিরও সুযোগ। ৫৪ বছরে বাংলাদেশ আশপাশের প্রায় সব দেশের সঙ্গে বহুমাত্রিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে তা হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো—দুই দেশ কি পারস্পরিক বোঝাপড়ার নতুন ভিত্তি তৈরি করতে পারবে?”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জিইসি বৈঠককে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেখা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি, আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC) প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ার ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বাংলাদেশ এই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার কৌশল নিচ্ছে—যেখানে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমিত অর্থনৈতিক সহযোগিতা উভয়ের জন্যই লাভজনক হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিয়া রহমান বলেন, “বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তান কোনো প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার নয়, কিন্তু আঞ্চলিক ভারসাম্য ও মুসলিম দেশগুলোর কূটনৈতিক সহযোগিতা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এটি প্রতীকী গুরুত্ব বহন করে। যদি এই বৈঠকে আস্থা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে সেটি ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোটের পথ সুগম করবে।”
সম্ভাবনার দিক: নতুন খাত ও সহযোগিতার ক্ষেত্র
দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তি, ওষুধ, কৃষি, উচ্চশিক্ষা ও জ্বালানি খাতে পারস্পরিক বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। পাকিস্তানের শক্তিশালী কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশের গার্মেন্টস ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে। এছাড়া, পাকিস্তানের তুলা ও সুতা আমদানির মাধ্যমে বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাত লাভবান হতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ওষুধ ও সিরামিক শিল্প পাকিস্তানি বাজারে দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেন, “আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নয়, সহযোগিতায় বিশ্বাস করি। যদি দু’দেশ যৌথভাবে কৃষি, আইটি এবং ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে কাজ করতে পারে, তাহলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে এবং আঞ্চলিক বাজারে অবস্থান শক্তিশালী হবে।”
জিইসি বৈঠক নিঃসন্দেহে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই বৈঠকের প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করবে দুই দেশের কূটনৈতিক সদিচ্ছা, বাণিজ্যিক বাস্তবতা এবং আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপর।
অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “দুই দশক পর যখন আমরা আবার আলোচনার টেবিলে বসছি, তখন শুধু কাগজে চুক্তি নয়—বাস্তব অগ্রগতি দেখাতে হবে। পরিবহন লজিস্টিক্স, বিনিয়োগ নিরাপত্তা, এবং রাজনৈতিক আস্থার প্রশ্নগুলো সমাধান না হলে এই উদ্যোগও অতীতের মতো আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত থাকবে।”
অতএব, ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য নবম যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠক হতে পারে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের নতুন সূচনা—অথবা কেবল এক পুনরাবৃত্তি। এখন দেখার বিষয়, দুই দেশের নীতিনির্ধারকরা কথার চেয়ে কাজে কতটা এগিয়ে যেতে পারেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



