ছবি: সংগৃহীত
তিন বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত আফ্রিকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দেশ সুদান বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভাষায়, দেশটিতে চলমান সংঘাত এখন “বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ বাস্তুচ্যুতি পরিস্থিতি”-তে পরিণত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন, কোটি কোটি মানুষ খাদ্য ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, এবং একটি সম্পূর্ণ জাতি ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে।
২০২২ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া সুদানের গৃহযুদ্ধ মূলত দেশটির সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত হয়। প্রথম দিকে রাজধানী খার্তুম ও দারফুর অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যেই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। বিমান হামলা, স্থলযুদ্ধ ও জাতিগত সহিংসতার কারণে গ্রাম পর গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, সংঘাত শুরুর পর থেকে প্রায় ১৪ হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং দেড় কোটিরও বেশি মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলমান সংঘাতে স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য সরবরাহ, শিক্ষা ও পানি সরবরাহব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, বর্তমানে সুদানের ৩ কোটি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। এদের মধ্যে ৯৬ লাখ মানুষ দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত, অর্থাৎ তারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। আরও ৪৩ লাখ মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো—চাদ, দক্ষিণ সুদান, মিসর, ইথিওপিয়া ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে—পালিয়ে গেছে।
আইওএমের রিপোর্টে বলা হয়, এই বাস্তুচ্যুতি কেবল সংখ্যা নয়, বরং এটি আধুনিক যুগের সবচেয়ে দ্রুত ও ভয়াবহ জনসংখ্যা স্থানান্তরের এক উদাহরণ। অনেক শরণার্থী নারী ও শিশুদের মধ্যে রয়েছে, যারা যুদ্ধ, ক্ষুধা ও রোগে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)-এর কর্মকর্তা টেড চাইবান জানিয়েছেন, সুদানের এই ভয়াবহ সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। দেশটির প্রায় ১৪ লাখ শিশু বর্তমানে মারাত্মক অপুষ্টি ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে, আর ১ কোটি ৪০ লাখ শিশু স্কুলের বাইরে, যা দেশের মোট শিশুর চার-পঞ্চমাংশ।
শুধু উত্তর দারফুর প্রদেশেই চলতি বছর ১ লাখ ৫০ হাজার শিশু মারাত্মকভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। অনেক এলাকায় চিকিৎসা বা খাদ্য সহায়তা পৌঁছাতে না পারায় শিশু মৃত্যুর হার ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে।
চাইবান বলেন, “সুদানে একটি সম্পূর্ণ প্রজন্ম বিলীন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শিক্ষা, পুষ্টি ও নিরাপত্তা—এই তিনটি মৌলিক অধিকারই আজ সুদানি শিশুদের কাছে বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিওএফপি)-এর আঞ্চলিক পরিচালক ভ্যালেরি গুয়ারনিয়েরি জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বর মাসে সংস্থাটি দুর্ভিক্ষঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রায় ১৮ লাখ মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সম্পূর্ণভাবে অপ্রবেশযোগ্য।
তিনি বলেন, “যেসব এলাকায় সংঘাত সবচেয়ে বেশি, সেখানে মানবিক ত্রাণবাহী যানবাহন পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কিছু এলাকায় ত্রাণকর্মীদের ওপরও হামলা হচ্ছে। ফলে শত শত গ্রামে মানুষ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।”
জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা সতর্ক করেছে, যদি দ্রুত সহায়তা না বাড়ানো হয়, তবে সুদান শিগগিরই বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দেশে পরিণত হতে পারে।
যুদ্ধের কারণে মানবিক সংস্থাগুলোর জন্য দেশটিতে প্রবেশাধিকার অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে কাজ চালানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা ও প্রশাসনিক বাধার কারণে সহায়তা কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না।
ইউএনএইচসিআর-এর উপ-উচ্চকমিশনার কেলি ক্লেমেন্টস বলেন, “সুদানে এখন প্রতিদিন নতুন শরণার্থী তৈরি হচ্ছে। গৃহহীন মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে কোনো আন্তর্জাতিক সংকটের সঙ্গেই এর তুলনা চলে না।” তিনি আরও বলেন, “এক-তৃতীয়াংশ সুদানি এখন গৃহহীন, এটি কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি মানব সভ্যতার জন্য এক অশ্রুত বেদনার গল্প।”
জাতিসংঘের চারটি প্রধান সংস্থা—ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, ডব্লিওএফপি ও আইওএম—যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, সুদানের মানবিক বিপর্যয় এখন “অচিরেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে”। তারা দ্রুত আন্তর্জাতিক তহবিল সহায়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মানবিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং শান্তি পুনঃস্থাপনের প্রচেষ্টা জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে।
এই আহ্বানে বলা হয়, “এখনই যদি বিশ্ব একসাথে না আসে, তবে আমরা সুদানে একটি হারিয়ে যাওয়া প্রজন্ম এবং ভেঙে পড়া রাষ্ট্রের সাক্ষী হবো।”
সুদান আজ এমন এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি, যেখানে ক্ষুধা, সহিংসতা ও অনিশ্চয়তা জীবনের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। তিন বছরের গৃহযুদ্ধ দেশটিকে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে—যা শুধুমাত্র সুদান নয়, বরং গোটা আফ্রিকা এবং আন্তর্জাতিক মানবতার জন্য এক কঠিন সতর্কবার্তা।
যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ইতিহাসে সুদানের এই অধ্যায় চিহ্নিত হয়ে থাকবে—“একটি জাতির ধ্বংসের গল্প” হিসেবে।
সূত্র: দ্য আরব নিউজ, জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, আইওএম, ডব্লিওএফপি
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



