ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত, যা দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রেখেছে, বর্তমানে এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজারগুলোতে স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে নেমে এসেছে এক অশনিসংকেত। বিশেষ করে সৌদি আরব ছাড়া দেশের চারটি প্রধান গন্তব্য—সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ওমান এবং কুয়েতে—শ্রমবাজার প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই বাজারগুলো পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়নি। তার ওপর ভরসার বাজার সৌদি আরবেও দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা। ফলে বিদেশে কর্মী পাঠানোর হার ক্রমেই কমছে, যা দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে বিদেশে কর্মী গেছেন ৮ লাখ ১৩ হাজার ৬৪ জন। অথচ ২০২২ সালের একই সময়ে বিদেশে গিয়েছিলেন ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৭৩৯ জন এবং ২০২৩ সালে ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৫ জন। তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে কর্মী প্রেরণ কমেছে যথাক্রমে ৭.৫ শতাংশ ও ১৭.৮৫ শতাংশ।
অবশ্য ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় এ বছর কর্মী প্রেরণ বেড়েছে ১৬.৩৯ শতাংশ। তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বৃদ্ধি টেকসই নয়। কারণ, মূলত সৌদি আরবেই কর্মী পাঠানো বেড়েছে, অন্যদিকে অন্যান্য বাজারে প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে আছে।
বাংলাদেশি কর্মীদের সবচেয়ে বড় গন্তব্য সৌদি আরব। চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৬৭ শতাংশের বেশি গেছেন সৌদি আরবে, যার সংখ্যা ৫ লাখ ৫০ হাজার ৫৯৭ জন। কিন্তু এই বাজারেও ধীরে ধীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিচ্ছে।
রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, এখন দেশটিতে কাজ করতে হলে ‘তাকামুল’ নামের দক্ষতা সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই পরীক্ষা দিতে প্রতিজন কর্মীর জন্য গড়ে ৫০ ডলার খরচ করতে হচ্ছে, যা অনেকের সামর্থ্যের বাইরে। এছাড়া পরীক্ষার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া থেকে শুরু করে সার্টিফিকেট সংগ্রহ পর্যন্ত নানা জটিল প্রক্রিয়া পার হতে হচ্ছে।
বায়রা’র সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন, “তাকামুল পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা মূলত শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোকে আরও জটিল করছে। দক্ষ কর্মীদের জন্য এই পরীক্ষা থাকা উচিত, কিন্তু ক্লিনার বা সাধারণ শ্রমিকদের জন্য এটি অযৌক্তিক। এতে খরচ ও সময় দুই-ই বাড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারি পর্যায়ে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াকে সহজ করতে হবে। নয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই বাজারেও প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে যেতে পারে।”
অন্যদিকে, সৌদি আরবে কর্মরত শ্রমিকদের অভিযোগ, আকামা নবায়ন, চাকরির পরিবর্তন, বেতন-বৈষম্যসহ বিভিন্ন সমস্যায় তাঁরা ভুগছেন। স্থানীয় স্পন্সর বা ‘কাফালা’ ব্যবস্থার জটিলতাও অনেকের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
গত সরকারের আমলে দুর্নীতি, অনিয়ম, মানবপাচার ও অবৈধ অভিবাসনের অভিযোগে বন্ধ হয়ে যায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ওমানসহ নয়টি গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও অন্তর্বর্তী সরকার এই বাজারগুলোর কোনোটি পুনরায় চালু করতে পারেনি।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হলেও বাস্তব কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি কবে নাগাদ বাজারগুলো পুনরায় খোলা যাবে, তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ড. রাশেদ মাহমুদ খান বলেন, “বর্তমানে বিদেশি শ্রমবাজার নিয়ে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা খুবই দুর্বল। মালয়েশিয়া, ওমান ও ইউএই–এর মতো ঐতিহ্যবাহী বাজারগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এখনই যদি কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের শ্রমবাজার স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকার জাপানের বাজারে এক লাখ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্য ঘোষণা করেছিল। এ লক্ষ্যে গঠন করা হয় ‘জাপান সেল’, যা জাপানি ভাষা, সংস্কৃতি ও কর্মদক্ষতা প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ছিল।
তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৯ মাসে মাত্র ৯৬২ জন কর্মী জাপানে গেছেন। অথচ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিবন্ধিত ৬২টি রিক্রুটিং এজেন্সি এক জন কর্মীকেও পাঠাতে পারেনি। এ কারণে মন্ত্রণালয় তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে।
শ্রমবাজার বিশ্লেষক ড. ফারজানা সাবের মন্তব্য করেন, “জাপান সেল গঠন একটি ভালো উদ্যোগ হলেও এর বাস্তবায়নে গতি নেই। ভাষা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, নইলে এই বাজারও হারানোর ঝুঁকি আছে।”
মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে প্রায় ১৭ হাজার কর্মী যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। বর্তমানে দেশটি প্রথম ধাপে ৮ হাজারের মতো কর্মী নেওয়ার আগ্রহ দেখালেও প্রক্রিয়াগত জটিলতায় সময়মতো পাঠানো সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
বোয়েসেল সূত্রে জানা গেছে, কর্মীদের আবেদন ও সনদ যাচাইয়ের কাজ চলছে, তবে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ এখনো চাহিদাপত্র পাঠায়নি। এর ফলে ডিসেম্বরের মধ্যে কর্মীদের পাঠানো সম্ভব না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বোয়েসেলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত নিয়োগদাতাদের চাহিদাপত্র না আসে, আমরা কোনো কর্মী পাঠাতে পারব না। এখনো প্রশাসনিক স্তরে অনেক বাধা রয়ে গেছে।”
বাংলাদেশের অভিবাসন খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের শ্রমবাজার ক্রমে দক্ষতার দিকে ঝুঁকছে, অথচ বাংলাদেশ এখনো আধুনিক চাহিদা অনুযায়ী কর্মী তৈরি করতে পারছে না। প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, নির্মাণ, কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরি না হলে নতুন বাজার পাওয়া অসম্ভব।
বায়রা’র বর্তমান সদস্য সচিব আমিনুল হক চৌধুরী বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শ্রমবাজার নিয়ে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। দক্ষতা উন্নয়নে বড় ধরনের বাজেট বরাদ্দ, বিদেশি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব এবং গবেষণার মাধ্যমে নতুন বাজার সনাক্ত করতে হবে।”
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল প্রায় ২,২০,০০০ কোটি টাকা, যা অর্থনীতির অন্যতম স্থিতিশীলতা রক্ষা করেছে। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানিতে পতন অব্যাহত থাকলে এ খাত বড় ধাক্কা খাবে।
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিমুল হক খান বলেন, “শ্রমবাজারের পতন মানে রেমিট্যান্সের পতন। এটি সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি সক্ষমতা এবং সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করবে। সরকার এখনই যদি দৃঢ় পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আগামী দুই বছরের মধ্যে এই খাত মারাত্মক সংকটে পড়বে।”
বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সৌদির বাজারে কঠিন নিয়ম, অন্যান্য বাজারের স্থবিরতা এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানে অনীহা—সব মিলিয়ে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
অভিবাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এই সংকট কাটাতে হলে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ, গবেষণাভিত্তিক নীতি এবং দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এখনই যদি প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি হস্তক্ষেপ না করেন, তবে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতের সোনালি অধ্যায় হয়তো ধীরে ধীরে ইতিহাসে পরিণত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



