ছবি: সংগৃহীত
দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর চট্টগ্রাম অঞ্চলে এক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ২২টি পোশাক কারখানা। এতে কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। শিল্প পুলিশ, বিজিএমইএ ও শ্রম বিশেষজ্ঞদের তথ্য বলছে—আর্থিক সংকট, এলসি জটিলতা, অর্ডার হ্রাস, ব্যাংকিং অনিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক বাজারে ট্যারিফ বৃদ্ধিসহ নানা কারণে এই শিল্প খাত মারাত্মক সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ইপিজেড ও আশপাশের শিল্পাঞ্চলে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ এবং শিল্পে অচলাবস্থার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ক্ষমতার পরিবর্তনের পর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত ২২টি পোশাক কারখানা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেছে। এর মধ্যে ১১টি কারখানা বন্ধ হয়েছে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে। এই ২২টি কারখানায় কর্মরত ছিলেন ৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক—যাদের বেশিরভাগই নারী।
শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) জসীম উদ্দিন বলেন, “বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর অধিকাংশই শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করেছে। তবে আমরা মনে করি প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ অনেক ছোট কারখানা বড় প্রতিষ্ঠানের সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করত। বড় কারখানা বন্ধ বা অর্ডার কমে গেলে ছোটগুলোও অচল হয়ে পড়ে।”
তিনি আরও জানান, শুধু আর্থিক সংকটই নয়, শ্রমিক অসন্তোষ, বিদ্যুৎ ঘাটতি এবং কাঁচামালের সংকটও অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন বন্ধের কারণ হয়েছে।
চট্টগ্রাম এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড)-এ এ বছর পাঁচ মাসে চারটি বড় কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে নাসা গ্রুপের টয় উড (বিডি) কোম্পানি লিমিটেড ও এমএনসি অ্যাপারেলস লিমিটেড, এছাড়া থিয়নিস অ্যাপারেলস লিমিটেড এবং জেএমএস গার্মেন্টস লিমিটেড। এসব কারখানায় প্রায় ৪ হাজার ৮০০ শ্রমিক কাজ করতেন।
নাসা গ্রুপের দুটি কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে শিল্প পুলিশ জানিয়েছে—ব্যাংক জটিলতা, এলসি অনিশ্চয়তা ও অর্ডারের ঘাটতি। গ্রুপটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের অক্টোবরে গ্রেপ্তার হন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের একাধিক মামলা রয়েছে, যা গ্রুপের ব্যাংকিং কার্যক্রমকেও বাধাগ্রস্ত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
থিয়নিস অ্যাপারেলস লিমিটেডের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা গত বছর থেকেই ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার কম পেতে শুরু করি। এরপর ব্যাংক এলসি জটিলতা দেখা দেয়। মালিকপক্ষ বারবার চেষ্টা করেও আর্থিক প্রবাহ সচল রাখতে পারেনি। অবশেষে চলতি আগস্টে উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়।”
শিল্প পুলিশের তথ্য বলছে, গত এক বছরে চট্টগ্রামের ৭০টি কারখানায় ৩১৫ বার শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে বেতনভাতা, ওভারটাইম ও চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে বিরোধই এসব ঘটনার মূল কারণ।
সবশেষ গত ১৪ ও ১৫ অক্টোবর প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের কয়েকটি কারখানায় বেতন বৈষম্য নিয়ে ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলন হয়। ফলে গ্রুপটি আটটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। যদিও পরে শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের আলোচনার পর ২৪ অক্টোবর থেকে কারখানাগুলো পুনরায় চালু হয়েছে।
পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানায়, বর্তমানে চট্টগ্রামে তাদের সদস্যভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৬৯৯টি। এর মধ্যে ৬১০টি ‘কার্যকর’ হিসেবে তালিকাভুক্ত, কিন্তু বাস্তবে চালু আছে মাত্র ৩৪৮টি। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি কারখানা বর্তমানে আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ অবস্থায় রয়েছে।
বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, “বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে পোশাক কারখানা টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন। যে সব কারখানায় শক্তিশালী কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থা আছে তারা কোনোভাবে টিকে আছে, কিন্তু বায়িং হাউস নির্ভর ছোট ফ্যাক্টরিগুলো টিকতে পারছে না। অর্ডার কমে গেছে, দাম কমেছে—সব মিলিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি।”
তিনি আরও বলেন, “আমেরিকার নতুন ট্যারিফ ঘোষণার পর চট্টগ্রামের কারখানাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ এখানকার কারখানাগুলোর বড় অংশ মার্কিন ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল। নতুন ট্যারিফের কারণে রপ্তানি আয় কমে গেছে, অথচ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে লাভ তো দূরের কথা, টিকে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক মনে করেন, কারখানা বন্ধ হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবও রয়েছে।
“গত এক বছরে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস, আমদানি সীমাবদ্ধতা এবং ব্যাংক ঋণ সংকট পোশাক খাতকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। এই খাত শুধু শ্রমনির্ভর নয়, এটি পুরো বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি মূল উৎস। চট্টগ্রাম অঞ্চলে কারখানা বন্ধ মানে পুরো দেশের রপ্তানি প্রবাহে ধস।”
তিনি আরও বলেন, “এখন জরুরি প্রয়োজন—একটি ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিকভারি প্যাকেজ’, যা আর্থিক সহায়তা, ট্যারিফ সুবিধা ও রপ্তানি প্রণোদনা বাড়িয়ে এই খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।”
অন্যদিকে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি শাহানা আক্তার বলেন, “প্রতিবার সংকটের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্রমিকরা। অনেক কারখানার শ্রমিকদের পাওনা এখনো পরিশোধ হয়নি। আবার যারা নতুন চাকরি খুঁজছেন, তারা অর্ডার কমে যাওয়ায় কোনো প্রতিষ্ঠানেই কাজ পাচ্ছেন না। এটা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক সংকটেও রূপ নিচ্ছে।”
বাণিজ্য বিশ্লেষক মো. ফরিদুজ্জামান, যিনি দীর্ঘদিন ধরে পোশাক রপ্তানি খাত নিয়ে কাজ করছেন, বলেন— “চট্টগ্রামের অনেক কারখানার এলসি খোলার অনুমোদন এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলো ডলার সংকটে আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। ফলে কাঁচামাল আসছে দেরিতে, উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বৈদেশিক ক্রেতাদের আস্থাহীনতা।”
তিনি আরও বলেন, “যদি এখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে একটি বিশেষায়িত ‘পোশাক পুনরুদ্ধার প্রণোদনা প্যাকেজ’ চালু না করে, তাহলে আগামী বছরে এই সংখ্যাটি দ্বিগুণ হতে পারে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকের আগে এই খাতের পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা খুবই সীমিত। বিশ্ববাজারে মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ও মার্কিন ট্যারিফ—সব মিলিয়ে রপ্তানিমুখী শিল্পের পুনরুদ্ধার কঠিন হবে।
বিজিএমইএ নেতা আবু তৈয়ব বলেন, “যদি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে, তাহলে হয়তো আগামী বছর মাঝামাঝি থেকে অর্ডার বাড়তে পারে। তবে তার আগে আমাদের কারখানা মালিকদের বাঁচাতে সরকারকে বিশেষ আর্থিক সুরক্ষা দিতে হবে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “চট্টগ্রামের পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। একে অবহেলা করা মানে পুরো রপ্তানি খাতকে ঝুঁকিতে ফেলা। এখনই সময়, সরকার, ব্যাংক ও রপ্তানিকারকদের এক টেবিলে বসিয়ে স্থায়ী সমাধান খোঁজার।”
বর্তমানে চট্টগ্রামে একের পর এক কারখানা বন্ধের এই প্রবণতা শুধু আঞ্চলিক অর্থনীতিকেই নয়, জাতীয় পর্যায়েও গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামী এক বছরের মধ্যেই পোশাক খাতে এক নতুন ধস নেমে আসতে পারে—এমন আশঙ্কাই করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



