ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে গিয়ে এক জটিল ও বহুস্তরীয় আইনি, সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। সনদটি ঘোষণার পর এখন তার বাস্তবায়নের পথ কীভাবে নির্ধারিত হবে, সেই প্রশ্নই সবচেয়ে বড় বিতর্কে পরিণত হয়েছে। সনদটি গণভোটে অনুমোদিত হলেও এবং সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে আইনি বৈধতা পেলেও, পরবর্তী সংসদে তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যাবে কীভাবে—এ নিয়েই এখন কমিশন ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গভীর মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। শনিবার (২৬ অক্টোবর) এ নিয়ে আবারও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুলাই সনদ যখন প্রণয়ন করা হচ্ছিল, তখন এর বাস্তবায়ন কাঠামো বা প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। সনদের মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র ও সংবিধান সংস্কারের দিকনির্দেশনা তৈরি করা। পরে কমিশনের দীর্ঘ পরামর্শ ও আলোচনার মাধ্যমে সনদের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি প্রাথমিক সমঝোতা তৈরি করে। কিন্তু সনদের আইনি বৈধতা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়, যা এখন পুরো প্রক্রিয়াকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটের মাধ্যমে সনদের অনুমোদনে একমত হলেও গণভোটের সময়, প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে একমত হতে পারেনি। এ অবস্থায় কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়—সনদের পাশাপাশি একটি পৃথক বাস্তবায়ন পদ্ধতির প্রস্তাব সরকারকে দেওয়া হবে।
কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংস্কার প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ৩০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৫টি দল ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন সংক্রান্ত প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছে। তবে পাঁচটি দল এখনো স্বাক্ষর করেনি। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা জানিয়েছে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন কাঠামো নির্দিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনো দলিলেই স্বাক্ষর করবে না।
গত ১৭ অক্টোবর সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর থেকে কমিশন টানা কাজ করছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণে। কিন্তু প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে কমিশনকে।
কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, সনদের আইনি ভিত্তি স্থাপনে একটি সাংবিধানিক আদেশ জারি করা হবে, যার নাম হতে পারে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ-২০২৫’। এটি বিদ্যমান সংবিধান ও আইনগুলোর পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কমিশনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, “গণ-অভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে” বিশেষ পরিস্থিতিতে এই আদেশ জারি করা হবে, এরপর একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।
কিন্তু এখানেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিএনপি বলছে, বিদ্যমান আইনের অধীনে নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি মনে করছে, সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে হবে। এই মতবিরোধে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, আগামী সংসদের দুটি দায়িত্ব থাকবে। প্রথমত, ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করে জুলাই সনদে নির্ধারিত সংস্কারসমূহ ৯ মাস বা ২৭০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করা। দ্বিতীয়ত, একই সঙ্গে নিয়মিত সংসদ হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা অব্যাহত রাখা, পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন—সংবিধান সংস্কার পরিষদ যদি ৯ মাসের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন না করে, তবে কী হবে? কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, সময়সীমা পেরিয়ে গেলে সংসদ এবং পরিষদ—উভয়ই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হবে। তখন একটি নতুন জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। কিন্তু সেই নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে? কারণ সংস্কার ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসবে না।
বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় উঠে এসেছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—গণভোটে প্রশ্নটি কীভাবে উপস্থাপন করা হবে? কমিশনের প্রস্তাব হলো, প্রশ্নটি হবে খুবই সরল:
“আপনি কি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ এবং প্রস্তাবিত সংস্কারসমূহ সমর্থন করেন?”
উত্তর হবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’। কিন্তু সনদের বিভিন্ন প্রস্তাবে বিএনপিসহ বেশ কিছু দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত দিয়েছে—বিশেষ করে সংবিধানের ৯টি বিষয়ে। প্রশ্ন হলো, গণভোটে যদি ‘হ্যাঁ’ পাস হয়, তাহলে বিএনপি যদি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে সরকার গঠন করে, তারা কি এই ‘ডিসেন্ট’ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে, নাকি নতুন করে সংস্কারের উদ্যোগ নেবে?
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক উঠেছে—সংবিধান সংস্কারের জন্য বর্তমান আইনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। কিন্তু ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’-এর ক্ষেত্রে কি একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে? নাকি সেখানে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যথেষ্ট হবে?
যদি আগামী সংসদে কোনো দল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, কিংবা সংসদ ঝুলন্ত হয়, তাহলে সংস্কার প্রক্রিয়া থেমে যেতে পারে। তেমন হলে আবার নির্বাচন আয়োজন করতে হবে, কিন্তু ততক্ষণে সাংবিধানিক কাঠামোও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
বড় প্রশ্ন এখন—সাংবিধানিক আদেশ জারি করবেন কে? রাষ্ট্রপতি, না প্রধান উপদেষ্টা? বিএনপি এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা দেওয়ার বিরোধিতা করছে। আবার জামায়াত ও এনসিপি রাষ্ট্রপতির আদেশও মানতে রাজি নয়। তাদের মতে, “অন্তর্বর্তী সরকার” বা “অস্থায়ী সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ”-এর মাধ্যমে আদেশ জারি করতে হবে, যাতে কোনো দলীয় প্রভাব না থাকে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণে আমরা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আদেশের খসড়ায় কী কী থাকবে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষ হয়েছে। বাস্তবায়নের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো শনাক্ত করে আমরা বিকল্প সমাধানের পথও খুঁজছি। শনিবার বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠকের পর আগামী এক-দুই দিনের মধ্যে প্রস্তাবটি সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার আশা করছি।”
তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে এখনো বহু ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। আইনি ভিত্তি, গণভোটের কাঠামো, সংসদের কর্তৃত্ব, এবং বাস্তবায়নের রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি—সব মিলিয়ে এটি বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল সংস্কার প্রক্রিয়াগুলোর একটি হয়ে উঠছে।
জুলাই সনদ রাষ্ট্র সংস্কারের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে—যদি বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়। কিন্তু যদি সেই ঐকমত্য না আসে, তাহলে এই সনদই আবার নতুন এক সাংবিধানিক অচলাবস্থার সূচনা করতে পারে, যার ফলাফল অনিশ্চিত ও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



