ছবি: সংগৃহীত
ফুটবলের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় রচনা করলেন পর্তুগিজ সুপারস্টার ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। গোলের পর গোল করে তিনি যে এখনও থেমে নেই, তা আবারও প্রমাণ করলেন সৌদি প্রো লিগে। শনিবার রাতে আল নাসরের জার্সিতে মাঠে নেমে প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠিয়ে বিশ্বের প্রথম ফুটবলার হিসেবে ৯৫০ গোলের অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করলেন তিনি।
রোনালদোর এই অবিশ্বাস্য অর্জনে ফুটবল বিশ্বে তৈরি হয়েছে নতুন ইতিহাস। আইএফএফএইচএস (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফুটবল হিস্টোরি অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস) অনুযায়ী, এই মুহূর্তে রোনালদোর ক্যারিয়ার গোলসংখ্যা ৯৫০—যা প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে অন্য যে কোনো খেলোয়াড়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে।
রোনালদো আগেই বলেছিলেন—তার লক্ষ্য এক হাজার গোল। বয়স ৪০ পেরোলেও মাঠে তার ক্ষুধা ও শারীরিক সক্ষমতা অবাক করে দেয় সবাইকে। আল নাসরের হয়ে শনিবার রাতে সৌদি প্রো লিগের ম্যাচে আবারও নিজের নাম তুললেন স্কোরশিটে, যা তার ক্যারিয়ারের ৯৫০তম গোল হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেল।
আল নাসর ওই ম্যাচে ২-০ ব্যবধানে জয় পায়। রোনালদো ছাড়াও আরেক পর্তুগিজ তারকা জোয়াও ফেলিক্স গোল করেন দলের হয়ে। রোনালদোর গোলটি আসে প্রথমার্ধে, তার trademark clinical ফিনিশিংয়ে। গোলের পর পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে ধ্বনিত হয় “সিউউউ!”—যা রোনালদো ভক্তদের কাছে আরেকটি আবেগময় মুহূর্ত হয়ে ওঠে।
ম্যাচ শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন রোনালদো। নিজের ভেরিফায়েড এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্টে তিনি লেখেন, “দলকে সাহায্য করতে পেরে এবং ৯৫০ গোলের মাইলফলক ছুঁতে পেরে আমি আনন্দিত। আমি সবসময় আরও বেশি অর্জনের ক্ষুধায় আছি। সামনে পথ এখনো লম্বা।”
তার এই বার্তা মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়। সারা বিশ্বের ভক্তরা তাকে অভিনন্দন জানান। অনেকেই লিখেছেন—“GOAT (Greatest Of All Time)”—যা রোনালদোর দীর্ঘ ক্যারিয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।
আইএফএফএইচএসের তথ্য অনুসারে, রোনালদোর এই ৯৫০ গোল এসেছে ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। ইউরোপের মঞ্চে তিনি খেলেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ ও জুভেন্টাসের হয়ে। এছাড়া পর্তুগালের হয়ে জাতীয় দলের জার্সিতে তিনটি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও পাঁচটি বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
নিচে তার ক্লাবভিত্তিক গোলসংখ্যার একটি সারসংক্ষেপ—
| ক্লাব/দল | গোল সংখ্যা | সময়কাল |
|---|---|---|
| স্পোর্টিং লিসবন | ৫ | ২০০২–২০০৩ |
| ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড | ১৪৫+ | ২০০৩–২০০৯, ২০২১–২০২২ |
| রিয়াল মাদ্রিদ | ৪৫০ | ২০০৯–২০১৮ |
| জুভেন্টাস | ১০১ | ২০১৮–২০২১ |
| আল নাসর (সৌদি আরব) | ৫৬+ | ২০২৩–বর্তমান |
| পর্তুগাল জাতীয় দল | ১২৭+ | ২০০৩–বর্তমান |
মোট: প্রায় ৯৫০ গোল (প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে)।
এই গোলগুলোর মধ্যে ৬৫০টির বেশি এসেছে লিগ ও কাপ প্রতিযোগিতায়, ১৪০টির বেশি চ্যাম্পিয়নস লিগে, আর বাকি গোলগুলো আন্তর্জাতিক ম্যাচে।
রোনালদোর পরেই আছেন লিওনেল মেসি, যিনি ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত করেছেন ৮৯১ গোল। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী এই তারকা বর্তমানে মেজর লিগ সকার (এমএলএস) ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে খেলছেন। তার গোলের সংখ্যা কিছুটা থেমে গেলেও রোনালদোর সঙ্গে গোলের এই ‘অল-টাইম রেস’ ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম রোমাঞ্চকর অধ্যায় হয়ে আছে।
তৃতীয় স্থানে আছেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলে, যিনি অফিসিয়াল পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৭৬২টি প্রতিযোগিতামূলক গোল করেছিলেন। তবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সব ম্যাচ মিলিয়ে পেলের গোল সংখ্যা ১,২৮১—যার মধ্যে ট্যুর, প্রদর্শনী ও প্রীতি ম্যাচও অন্তর্ভুক্ত।
| অবস্থান | খেলোয়াড় | গোল সংখ্যা | দেশ |
|---|---|---|---|
| ১ম | ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো | ৯৫০ | পর্তুগাল |
| ২য় | লিওনেল মেসি | ৮৯১ | আর্জেন্টিনা |
| ৩য় | পেলে | ৭৬২ (অফিসিয়াল) / ১,২৮১ (গিনেস রেকর্ড) | ব্রাজিল |
রোনালদোর গোলসংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক থাকলেও আইএফএফএইচএস তার গোল গণনায় শুধু প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচগুলোই অন্তর্ভুক্ত করেছে। অর্থাৎ, প্রীতি ম্যাচ বা প্রশিক্ষণমূলক ম্যাচগুলোকে বিবেচনা করা হয়নি। ফলে তার ৯৫০ গোলের রেকর্ড একেবারে নিখাদ ও প্রমাণযোগ্য অর্জন।
রোনালদোর এই কীর্তি ফুটবলের ইতিহাসে এককভাবে অনন্য, কারণ এখন পর্যন্ত কোনো খেলোয়াড়ই ৯০০ গোলের মাইলফলক ছুঁতে পারেননি। তার পেছনে থাকা মেসি ৮৯১ গোল নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে, যা পার্থক্যে প্রায় ৬০ গোলের।
রোনালদো এখন ৪০ ছুঁইছুঁই, তবুও শারীরিক ফিটনেস ও খেলার ক্ষুধায় তিনি তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য অনুপ্রেরণা। সৌদি প্রো লিগে যোগ দেওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন তার ক্যারিয়ার শেষ পর্যায়ে, কিন্তু রোনালদো প্রমাণ করেছেন—লিগ বা মহাদেশ নয়, যেখানেই তিনি খেলেন, গোল করার নেশা তার শিরায় বইছে।
ফুটবল বিশ্লেষকরা বলছেন, রোনালদো শুধু গোলমেশিনই নন, তিনি শৃঙ্খলা, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের জীবন্ত উদাহরণ। তার অনুশীলন, খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক দৃঢ়তা ফুটবল ইতিহাসে আদর্শ হিসেবে বিবেচিত।
৯৫০ গোলের এই রেকর্ড ছোঁয়ার পর এখন রোনালদোর দৃষ্টি এক হাজার গোলের মাইলফলকে। তার বর্তমান ফর্ম ও ফিটনেস বিবেচনায় অনেকেই মনে করছেন, এই লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব নয়। বিশেষ করে আল নাসরের হয়ে তিনি যদি আগামী দুই মৌসুম খেলেন, তাহলে বাকি ৫০ গোল যোগ করতে সময় লাগবে না।
পর্তুগালের জাতীয় দলে এখনও নিয়মিতভাবে খেলে যাচ্ছেন তিনি। ইউরো ২০২৮ পর্যন্ত খেলার আগ্রহও ব্যক্ত করেছেন রোনালদো। অর্থাৎ, তার ক্যারিয়ারের শেষ অধ্যায় এখনো লেখা শেষ হয়নি।
ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর নাম এখন শুধু রেকর্ডের তালিকায় নয়, ফুটবল ইতিহাসের এক অনুপ্রেরণার অধ্যায় হিসেবে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। ৯৫০ গোলের মাইলফলক তার ক্যারিয়ারের প্রতিটি অধ্যায়ের প্রতিফলন—স্পোর্টিংয়ের তরুণ রোনালদো থেকে শুরু করে রিয়াল মাদ্রিদের রাজত্ব, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে প্রত্যাবর্তন, জুভেন্টাসে চ্যালেঞ্জ, আর এখন সৌদির মরুভূমিতে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা—সব জায়গাতেই একই জ্বলন্ত প্রতিজ্ঞা: “আরো এক গোল, আরেকটা রেকর্ড।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



