ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতির মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর আবারও রক্তাক্ত রাতের সাক্ষী হলো গাজা। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ইসরায়েলি বাহিনী একযোগে ডজনখানেক স্থানে বিমান হামলা চালায়, যা যুদ্ধবিরতির পর থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে তীব্র ও বিধ্বংসী আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইসরায়েল বলেছে, দক্ষিণাঞ্চলে তাদের এক সেনা নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় এই অভিযান চালানো হয়েছে। তবে এই হামলার ফলে শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে বহু নারী ও শিশু রয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, “হামাস যোদ্ধাদের আগুনে একজন সেনা নিহত হওয়ার পর তাদের একাধিক সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করা হয়েছে।” একই সঙ্গে তারা ঘোষণা দেয়, যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে নতুন ‘কার্যকর প্রক্রিয়া’ চালু করা হবে। কিন্তু তাদের এই বিবৃতি প্রকাশের কয়েক মিনিট পরই গাজার আকাশজুড়ে বিস্ফোরণের আলো ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপির সরাসরি সম্প্রচারে দেখা যায়, একের পর এক বিস্ফোরণে শহরজুড়ে আগুনের গোলা তৈরি হচ্ছে, ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে পুরো দিগন্ত।
এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (তৎকালীন) ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করার সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না, তবে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।” তাঁর এই বক্তব্যে আন্তর্জাতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেক মানবাধিকার সংস্থা মনে করছে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই অবস্থান কার্যত গাজায় নতুন করে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে।
গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা দপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, ওই রাতের হামলায় অন্তত ১০৫ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৫ জন শিশু এবং অন্তত ১৭ জন নারী। শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের অনেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন। গাজার পাঁচটি প্রধান হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তারা এএফপিকে জানান, মৃতদের অধিকাংশই আবাসিক ভবন, স্কুল ও বাজার এলাকার বোমাবর্ষণের শিকার।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে গাজার আল-শিফা হাসপাতালে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, একাধিক রকেট হাসপাতালের পেছনের প্রাঙ্গণে আঘাত হানে, যেখানে তখন শতাধিক রোগী ও আশ্রয়প্রার্থী ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে প্রধান ভবন অক্ষত থাকলেও আশপাশে অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালের পরিচালক বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। মৃতদের দাফন করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।”
আল-শাতি শরণার্থী শিবিরের একটি অস্থায়ী স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৩১ বছর বয়সী খাদিজা আল-হুসনি। তিনি জানান, “আমরা ভেবেছিলাম অবশেষে একটু শান্তিতে নিশ্বাস নিতে পারব। ঘরবাড়ি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আবার বিস্ফোরণের শব্দে আকাশ কেঁপে উঠল। শিশুরা আতঙ্কে কাঁদছিল, কেউ কেউ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল। এটা কোনো যুদ্ধ নয়, এটা মানুষের ওপর বর্বরতা।”
খাদিজা আরও বলেন, “যদি যুদ্ধবিরতি সত্যি থাকে, তাহলে এ রকম বোমা হামলা কীভাবে হয়? একসঙ্গে যুদ্ধ আর শান্তি চলতে পারে না। আমাদের বাচ্চারা ভেবেছিল দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে—কিন্তু তা তো আবার ফিরে এল।”
অন্যদিকে হামাস জানিয়েছে, রাফা সীমান্ত এলাকায় যে গুলি চালানোর ঘটনার জেরে ইসরায়েল এই হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করছে, তার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সংগঠনটি বলেছে, তারা এখনো মার্কিন-সমর্থিত যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতিতে অটল রয়েছে এবং গাজায় শান্তি বজায় রাখতে কাজ চালিয়ে যাবে। হামাসের মুখপাত্র ফাওজি বারহুম বলেন, “ইসরায়েলের এই হামলা কেবল নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার অজুহাত। আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা আমাদের জনগণের নিরাপত্তা চাই।”
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, “গাজায় বেসামরিক মানুষদের ওপর এই ধারাবাহিক হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।” তিনি উভয় পক্ষকে অবিলম্বে সংযম দেখানোর আহ্বান জানান। ইউরোপীয় ইউনিয়নও একটি বিবৃতিতে বলেছে, “গাজায় পুনরায় সহিংসতা শুরু হওয়া গভীর উদ্বেগের কারণ। যুদ্ধবিরতি রক্ষা না হলে মানবিক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।”
এই হামলার পর গাজার অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনুস ও রাফা শহরের সঙ্গে গাজার উত্তরাংশের সংযোগ। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস বলছে, গাজায় হাসপাতালগুলো এখন “অমানবিক অবস্থার” মধ্যে কাজ করছে। অনেক চিকিৎসক দুই দিন ধরে টানা কাজ করছেন, কিন্তু পর্যাপ্ত ওষুধ বা জ্বালানি নেই।
গাজাবাসীর কাছে যুদ্ধবিরতি এখন এক বিভ্রান্তিকর শব্দে পরিণত হয়েছে। বারবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও হামলার পুনরাবৃত্তি মানুষকে হতাশ করে তুলছে। স্থানীয় শিক্ষক সালাহ জাবালি বলেন, “আমাদের সন্তানদের শেখানো কঠিন হয়ে গেছে যে শান্তি বলে কিছু আছে। যখন রাতের আকাশ আলোয় ভরে যায় বোমার আগুনে, তখন কেউ আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে না।”
এই পরিস্থিতিতে গাজা আবারও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত ঘরবাড়ির পাশে কান্নারত শিশু, আহতদের হাহাকার আর শোকার্ত পরিবারগুলো যুদ্ধবিরতির নাম শুনলে এখন কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যুদ্ধের আগুন আবার জ্বলতে শুরু করেছে—এবং গাজার মানুষ জানে না, এর শেষ কোথায়।
এইভাবেই যুদ্ধবিরতির পরের সবচেয়ে ভয়াবহ রাত গাজার ইতিহাসে আরেকটি কালো অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হলো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



