 
					ছবি: সংগৃহীত
দেশে ডিজিটাল কর ব্যবস্থাপনায় নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি ২০২৫-২৬ করবর্ষে ইতোমধ্যে ১০ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে ই-রিটার্ন দাখিল করেছেন, যা বাংলাদেশের কর ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এনবিআরের এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৪ আগস্ট অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অনলাইনে ই-রিটার্ন দাখিল কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে করদাতারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট **www.etaxnbr.gov.bd**-এর মাধ্যমে ঘরে বসেই অনলাইনে রিটার্ন পূরণ করে জমা দিতে পারছেন। খুব অল্প সময়েই করদাতাদের মধ্যে এই ব্যবস্থা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড জানিয়েছে, চলতি করবর্ষে অনলাইন রিটার্ন দাখিল কার্যক্রমে করদাতাদের অংশগ্রহণ অভূতপূর্ব। মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ১০ লাখের বেশি করদাতা ই-রিটার্ন দাখিল করেছেন, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এনবিআরের ভাষায়, “এটি কর সংস্কৃতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।”
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, “আমরা একটি আধুনিক, সহজ ও স্বচ্ছ কর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই। অনলাইন ই-রিটার্ন দাখিল সেই যাত্রার বড় পদক্ষেপ। দেশের নাগরিকেরা এখন কর পরিশোধের প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তি নির্ভরতার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন।”
চলতি ২০২৫-২৬ করবর্ষে এনবিআর এক বিশেষ আদেশের মাধ্যমে জানিয়েছে—সব ব্যক্তি করদাতাদের জন্য ই-রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক, তবে কিছু শ্রেণিকে এই বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতি পাওয়া শ্রেণিগুলো হলো—
- 
	৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের প্রবীণ করদাতা, 
- 
	শারীরিকভাবে অসমর্থ বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন করদাতা, 
- 
	বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতা, 
- 
	মৃত করদাতার আইনগত প্রতিনিধি, 
- 
	এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিক। 
তবে এনবিআর বলেছে, এই শ্রেণির করদাতারা চাইলে স্বেচ্ছায় অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। তাদের জন্য ওয়েবসাইটে বিশেষ ফিচার ও সাপোর্ট সুবিধা সংযোজন করা হয়েছে।
ই-রিটার্ন সিস্টেমে নিবন্ধন বা লগইন সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিলে করদাতারা আগামী ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত তাদের সংশ্লিষ্ট উপকর কমিশনারের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করতে পারবেন। সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে আবেদন করলে সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত বা যুগ্মকর কমিশনারের অনুমোদনক্রমে তারা হার্ডকপি বা পেপার রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
এনবিআর জানায়, “আমরা চাই সব করদাতাই ই-রিটার্নে যুক্ত হোন। তবে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা থাকলে করদাতাদের জন্য বিকল্প পথও উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।”
যেসব বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে অবস্থান করছেন, তাদের জন্যও অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের বিশেষ সুযোগ রাখা হয়েছে।
তারা তাদের পাসপোর্ট নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা ইত্যাদি তথ্য [email protected] এই ই-মেইলে পাঠালে আবেদনকারীর ই-মেইলে একটি ওটিপি (One Time Password) ও রেজিস্ট্রেশন লিংক পাঠানো হয়।
এর মাধ্যমে তারা সহজেই ই-রিটার্ন সিস্টেমে রেজিস্ট্রেশন করে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারেন। ফলে প্রবাসী করদাতাদের জন্য আলাদা দেশে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন নেই।
চলতি করবর্ষে করদাতারা তাদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি বা আয়কর আইনজীবী মারফতও ই-রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। ফলে যেসব করদাতা নিজের হাতে ফর্ম পূরণে অনিশ্চিত, তারা পেশাদার প্রতিনিধির মাধ্যমে নিরাপদে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন।
এছাড়া করদাতারা কোনো কাগজপত্র আপলোড না করেও শুধু তাদের আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের প্রকৃত তথ্য অনলাইন ফর্মে পূরণ করতে পারেন। রিটার্ন জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র (Acknowledgement Slip) এবং আয়কর সনদ (Tax Certificate) প্রিন্ট করে নিতে পারেন—যা আগে কাগজে আবেদন করে সংগ্রহ করতে হতো।
কর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-রিটার্ন ব্যবস্থাটি সহজ, দ্রুত ও স্বচ্ছ হওয়ায় করদাতারা আগের চেয়ে বেশি উৎসাহী হচ্ছেন। অনলাইনে আবেদন জমা দেওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে করদাতারা তাদের ফাইলিং ইতিহাস দেখতে পাচ্ছেন এবং সনদও নিজেই প্রিন্ট করতে পারছেন। ফলে সময় ও খরচ—দুটিই বাঁচছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ই-রিটার্ন দাখিল করেছিলেন প্রায় ৬ লাখ করদাতা, আর এবার মাত্র তিন মাসেই সেই সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০ লাখ। এটি ডিজিটাল কর প্রশাসনে এনবিআরের সাফল্যের বড় প্রমাণ।
ই-রিটার্ন প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য এনবিআর করদাতাদের পাশাপাশি আয়কর আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং চার্টার্ড সেক্রেটারিদের জন্যও বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
দেশের সব কর অঞ্চলে ই-রিটার্ন হেল্প-ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে অফিস সময়ের মধ্যে করদাতারা যেকোনো প্রশ্নের উত্তর ও পরামর্শ পাচ্ছেন।
এছাড়া ই-রিটার্ন সংক্রান্ত সহায়তার জন্য ০৯৬৪৩ ৭১ ৭১ ৭১ নম্বরে কল সেন্টার খোলা হয়েছে। করদাতারা সেখানে ফোন করে তাৎক্ষণিক সহায়তা পাচ্ছেন। একইসঙ্গে ওয়েবসাইটের eTax Service অপশন থেকেও করদাতারা লিখিতভাবে সমস্যা জানাতে পারেন এবং দ্রুত সমাধান পান।
সব করদাতাকে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ২০২৫-২৬ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন দাখিলের আহ্বান জানিয়েছে এনবিআর। সংস্থাটি বলেছে, “দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে টেকসই রাখতে করদাতাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। ই-রিটার্ন সিস্টেম সেই অংশগ্রহণকে আরও সহজ করেছে।”
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ই-রিটার্ন কেবল একটি প্রযুক্তি নয়, এটি কর সংস্কৃতিতে একটি বিপ্লব। বাংলাদেশ এখন কর প্রশাসনে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে করদাতারা নিজেরাই রাষ্ট্রের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখছেন।”
সব মিলিয়ে, অনলাইন ই-রিটার্ন দাখিলের এ সাফল্য শুধু রাজস্ব বোর্ডের নয়—এটি বাংলাদেশের ডিজিটাল প্রশাসনের এক বাস্তব দৃষ্টান্ত। আগামী বছরগুলোতে এই সংখ্যা আরও বহুগুণ বাড়বে বলে আশা করছে এনবিআর।
বাংলাবার্তা/এসজে
 
				.png)
.png)
.png)



