 
					ছবি: সংগৃহীত
দেশের রাজনীতি আবারও প্রবল ঘূর্ণাবর্তে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর যে “জুলাই জাতীয় সনদ” জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল, এখন সেটিই নতুন বিভাজনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ঐতিহাসিক ওই আন্দোলনের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো এখন কার্যত দুই শিবিরে বিভক্ত—একপক্ষে বিএনপি, বাম ও গণতান্ত্রিক দলগুলো; অন্যপক্ষে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং এনসিপিসহ ধর্মভিত্তিক বা ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো।
দলগুলোর অবস্থান এখন এতটাই বিপরীতমুখী যে, ঐকমত্যের বদলে শত্রুতা ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে। রাজনৈতিক মহল বলছে, বিরোধ এখন শুধু মতাদর্শের নয়, বরং প্রভাব, অবস্থান ও ভবিষ্যৎ ক্ষমতার রূপরেখা নিয়েও। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কেউ কেউ সরাসরি ‘গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা’র কথা বলছেন।
বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো অভিযোগ করছে, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া প্রস্তাব একতরফা, জবরদস্তিমূলক এবং সংবিধানবিরোধী।” দলটির ভাষ্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শের নামে প্রহসন করেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বলছে, “সনদ বাস্তবায়ন যেভাবে প্রস্তাবিত, সেটি দ্রুত কার্যকর করা না হলে রাজনৈতিক সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।”
এদিকে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—“ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হবে, আর সেই দায় পড়বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাঁধে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “রাজনৈতিক বিরোধ তীব্র পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সরকারও এখন বিভ্রান্ত—কীভাবে এই দ্বন্দ্ব সামলানো যায় তা নিয়ে।”
রাজনীতির এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সময়সূচি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
“ভেতর-বাহির থেকে বড় শক্তি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করবে”
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত বুধবার রাষ্ট্রীয় বাসভবন যমুনায় এক বৈঠকে বলেছেন, “নির্বাচন বানচালের জন্য ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকে বড় শক্তি কাজ করছে। ছোট নয়, বড় ধরনের আঘাত আসতে পারে। তবে যত ঝড়ঝঞ্ঝাই আসুক, আমাদের তা অতিক্রম করতে হবে।”
এই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন, এটি নির্বাচন নিয়ে সরকারের আশঙ্কার প্রতিফলন; আবার কেউ মনে করছেন, এ মন্তব্যের মাধ্যমে সরকার ভবিষ্যৎ কোনো অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়ার ফেসবুক পোস্ট। তিনি লিখেছেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আরও এক-দুই বছর থাকতে পারে, এরপর বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে।” তবে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন, “বিএনপি সহিংসতা দমন করতে ব্যর্থ হলে ১/১১-এর মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।”
এই পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়—২১৮ বার শেয়ার ও প্রায় ৪৫০টি মন্তব্যে অনেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। একজন মন্তব্য করেন, “আরও এক-দুই বছর সরকার থাকলে দেশ থাকবে স্যার?”
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল স্থায়ী কমিটির সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ঐকমত্য কমিশন ও সংস্কার কমিশনের দীর্ঘ আলোচনার পরও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়াটি জবরদস্তিমূলকভাবে জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি সময়ের অপচয়, জাতির সঙ্গে প্রহসন।”
তিনি বলেন, “বর্তমান সরকারের সংবিধান সংস্কারের কোনো এখতিয়ার নেই। গণভোটের আগে সংসদীয় নির্বাচন জরুরি, নইলে এটি হাস্যকর হয়ে উঠবে। একসঙ্গে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনই যৌক্তিক।”
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বলেছে, “নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট করতে হবে, এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ শুক্রবারের মধ্যেই জারি করতে হবে।” ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও একই সুরে বলেছে, “সনদ বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে দেশের স্থিতিশীলতা ঝুঁকিতে পড়বে।”
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “প্রস্তাবিত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সংবিধানবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক। এটি জনগণের মতামতের প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ।”
তিনি যোগ করেন, “সরকার নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়। নির্বাচনের নামে যদি কোনো কৌশল হয়, তবে সেটি জাতীয় স্থিতিশীলতার জন্য ভয়াবহ হবে। দ্রুত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।”
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “এই প্রস্তাব আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে যায় না। সরকার যদি বিশেষ কোনো দলের পক্ষে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে সরকার নিজেই বিপদে পড়বে।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, “ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐকমত্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। গণতন্ত্রের নামে এই প্রক্রিয়া চললে সংকট আরও গভীর হবে।”
বাসদ (মার্ক্সবাদী) নেতা মাসুদ রানা বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাব বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি বৈধতার প্রশ্ন তৈরি করবে এবং ভবিষ্যতে সাংবিধানিক বিপর্যয় ডেকে আনবে।”
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ। তাঁরা দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। এখনই সংলাপে বসতে হবে, নইলে ভয়াবহ সংকট তৈরি হবে।”
তিনি বলেন, “দুই মাস পর নির্বাচন হয়ে গেলে উপদেষ্টারা থাকবেন না। এখনই জনগণের দাবি শুনে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ খুঁজতে হবে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কে এম মহিউদ্দিন বলেন, “সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবটি একদিকে গণভোট নির্ভর, অন্যদিকে সংসদীয় পদ্ধতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধান সংশোধনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া সংসদের মাধ্যমে, কিন্তু এখানে জনগণকে সরাসরি ভোট দিতে বলা হয়েছে, যা কার্যত রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংসদ নির্ধারিত সময়ে সংস্কার সম্পন্ন করতে না পারলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে—এটি সংসদীয় সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, “জুলাই সনদ নিয়ে দলগুলোর বিরোধ হতাশাজনক। এখন সরকারের উচিত সংলাপ শুরু করা, আর দলগুলোর উচিত একধরনের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখানো।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান সরকার বিপ্লবী নয়, তাই সনদ বাস্তবায়নের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে গণ-আন্দোলনের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেওয়া উচিত নয়; প্রয়োজনে ভুলত্রুটি সংশোধন করে হলেও সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।”
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর একসময় জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখা দেওয়া “জুলাই সনদ” এখন রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। একপক্ষ বলছে, এটি গণতন্ত্র রক্ষার পথ; অন্যপক্ষের মতে, এটি সংবিধানবিরোধী ষড়যন্ত্র।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি এই বিভাজন আরও গভীর হয় এবং সংলাপের পথ বন্ধ হয়ে যায়, তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শুধু প্রশ্নবিদ্ধই হবে না, বরং দেশ নতুন এক রাজনৈতিক অস্থিরতার দিগন্তে প্রবেশ করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
 
				.png)
.png)
.png)



