 
					ছবি: সংগৃহীত
বহুল আলোচিত ও সংবেদনশীল ‘জয় বাংলা ব্রিগেড’ সম্পর্কিত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ ২৬১ জন আসামিকে পলাতক ঘোষণা করেছে আদালত। আদালতের নির্দেশে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টার ও আমার দেশ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে এই ঘোষণা প্রকাশ করেছে।
সিআইডির মিডিয়া শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপিএস) জসীম উদ্দিন খানের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ১৭ নম্বর শাখার বিচারক আরিফুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) শুনানি শেষে প্রধান আসামি শেখ হাসিনাসহ ২৬১ জনকে অনুপস্থিতিতে পলাতক ঘোষণা করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন। আদালতের ওই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতেই শুক্রবার এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মামলাটি ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড (সিআরপিসি) এর ১৯৬ ধারার অধীনে রাষ্ট্রের অনুমোদনক্রমে দায়ের করা হয়েছে। অনুমোদন দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এবং তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্তে উঠে আসে যে, ‘জয় বাংলা ব্রিগেড’ নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত সদস্যদের মাধ্যমে বৈধ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
সিআইডি জানায়, অভিযুক্তরা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ডিজিটাল সার্ভার ও এনক্রিপটেড চ্যানেল ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা, উসকানিমূলক বার্তা ও গোপন সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। এসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল বৈধ সরকারকে অস্থিতিশীল করা, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ভেঙে দেওয়া।
তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, অভিযুক্তদের অনেকেই প্রবাসে থেকে বিভিন্ন ডিজিটাল চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ ও প্রোপাগান্ডা পরিচালনা করছিলেন। এসব তথ্য প্রমাণ সিআইডি সংগ্রহ করেছে ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষণ, সাইবার ট্রেসিং এবং ইন্টারন্যাশনাল ডেটা রিকোয়েস্ট প্রোটোকল অনুসারে।
দীর্ঘ প্রায় নয় মাসের তদন্ত শেষে সিআইডি গত মাসে আদালতে শেখ হাসিনাসহ মোট ২৮৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। চার্জশিটে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়, কিভাবে অভিযুক্তরা ‘জয় বাংলা ব্রিগেড’ ব্যানারে একাধিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন।
চার্জশিটে সিআইডি তদন্তকারীরা দাবি করেন, “অভিযুক্তরা রাষ্ট্রের বিদ্যমান সরকার উৎখাত ও সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থাকে অকার্যকর করার জন্য বিদেশি শক্তির সহায়তায় অনলাইন প্রোপাগান্ডা এবং সমন্বিত ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা চালান।”
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আদালত অভিযুক্তদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে একাধিক সমন জারি করলেও তারা আদালতে হাজির হননি। পরবর্তীতে আইনানুযায়ী অনুপস্থিত আসামিদের পলাতক ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, পলাতক ঘোষিত আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও রয়েছেন কয়েকজন প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের সাবেক অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী এবং প্রবাসে অবস্থানরত কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
এ বিষয়ে সিআইডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “এই মামলাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আদালতের নির্দেশে আমরা পলাতক আসামিদের বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছি। পরবর্তী ধাপে আদালতের আদেশ অনুযায়ী সম্পত্তি ক্রোক বা অন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।”
তিনি আরও জানান, মামলাটি এখন পরবর্তী বিচারিক কার্যক্রমের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে আইনগত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ায় আদালত শিগগিরই মামলাটির প্রারম্ভিক শুনানির তারিখ নির্ধারণ করবেন।
এর আগে, একই মামলার অন্যতম আসামি শেখ হাসিনা ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগ ছাড়া গঠিত কোনো সরকারের অধীনে দেশে ফেরার প্রশ্নই ওঠে না। সেই বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল এবং মামলার রাজনৈতিক গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে এই মামলাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা হতে পারে। কারণ এর প্রধান আসামি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা।
বর্তমানে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী পলাতক আসামিদের উপস্থিতির জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আইনি নোটিশ ও প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আহ্বান জানানো হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা আত্মসমর্পণ না করলে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কার্যক্রম শুরু হতে পারে।
সিআইডির বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, “রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তদন্তের সব তথ্য আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।”
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মামলাটির পরবর্তী শুনানি নির্ধারণ করা হতে পারে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে, যেখানে আদালত চার্জগ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।
এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি শুধু একটি আইনি বিষয় নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তা এক নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে—যেখানে দেশের সাবেক শাসকদল ও তার নেত্রী প্রথমবারের মতো সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
 
				.png)
.png)
.png)



