ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকায় দীর্ঘদিনের একটি চিরচেনা সমস্যা—যানজট। প্রতিদিন লাখো মানুষকে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকতে হয় রাস্তায়, অফিস, স্কুল কিংবা বাজারে যাওয়ার পথে। এই চরম নাগরিক দুর্ভোগ নিরসনে গত সাত মাসে নতুন এক উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ট্রাফিক বিভাগ রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় চালু করেছে ৭০টি ডাইভারশন রুট, যেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল যানবাহনের চাপ ভাগ করে ট্রাফিক প্রবাহ স্বাভাবিক করা।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে—এই উদ্যোগ কতটা কার্যকর হলো? শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যাচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কোথাও সুফল মিললেও, আবার কোথাও এই ডাইভারশনই পরিণত হয়েছে চরম দুর্ভোগের কারণ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে পুরান ঢাকার ধোলাইখাল, সদরঘাট ও আশপাশের এলাকাবাসী।
পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকা ছিল এই নতুন ট্রাফিক পরীক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। আগে সদরঘাটগামী বাসগুলো রায়সাহেব বাজার মোড় হয়ে নিম্ন আদালতের সামনের রাস্তা পেরিয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত যেত। কিন্তু ডিএমপির নতুন পরিকল্পনায় সেই রুট পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন এসব বাস রায়সাহেব বাজার থেকে সরাসরি ধোলাইখাল হয়ে বানিয়ানগরে ইউটার্ন নেয়, তারপর আবার রায়সাহেব বাজার হয়ে গন্তব্যে ফিরে যায়।
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, এতে রায়সাহেব বাজার ও আদালত এলাকার যানজট কিছুটা লাঘব হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা—ধোলাইখাল হয়ে উঠেছে এক মৃত্যুফাঁদ। সরু রাস্তায় ভারী বাস চলাচলের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকে। রিকশা, প্রাইভেটকার, অটো রিকশা—সব এক জায়গায় গাদাগাদি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই নতুন রুট চালু হওয়ার পর থেকে এলাকায় প্রতিদিন সকাল-বিকেল একই চিত্র। রাস্তার পাশে দোকানপাটে ঢোকা যাচ্ছে না, ধুলাবালিতে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, এবং প্রতিদিনের ব্যবসায় পড়ছে মারাত্মক প্রভাব।
ধোলাইখাল রিকন্ডিশন ইঞ্জিন ও মোটরপার্টস মালিক সমিতির সভাপতি হাজী মো. ইস্রাফিল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যানজটের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য একদম থমকে গেছে। আগে দিনে ৩০–৪০ জন ক্রেতা আসত, এখন ১০ জনও আসে না। গাড়ির শব্দ, ধোঁয়া আর ধুলাবালিতে মানুষ এই এলাকায় ঢুকতে চায় না।”
তিনি আরও বলেন, “এই যানজটের প্রভাবে শুধু ব্যবসাই নয়, স্কুল–কলেজগামী শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীরাও বিপাকে পড়েছে। কয়েক মিনিটের পথ যেতে এখন লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। অনেকে বিকল্প রাস্তা খুঁজছেন, কেউ আবার কাজ ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন।”
ধোলাইখালের প্রায় ১০ হাজার দোকান ও ওয়ার্কশপে কাজ করেন এক লাখের বেশি শ্রমিক ও ব্যবসায়ী। কিন্তু এখন তাদের কর্মসংস্থানই হুমকির মুখে। রাস্তা স্থবির হয়ে যাওয়ায় মালামাল আনা–নেওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ডাইভারশনের শিকার শুধু ব্যবসায়ী নয়—ভুক্তভোগী সদরঘাটের হাজারো যাত্রীও। প্রতিদিন সকালে অফিসগামী লোকজনের দীর্ঘ লাইন পড়ে ধোলাইখালের জ্যামে। গরমে, ধোঁয়ায়, শব্দে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে।
বাসচালক আব্দুল জলিল বলেন, “এখন রাস্তায় চলাই কঠিন। ইউটার্ন নিতে গিয়ে আধাঘণ্টা সময় লাগে। রাস্তায় এত গাড়ি যে বাস চালানো মানেই ঝুঁকি। যাত্রীও কমে গেছে, কারণ তারা এখন অন্য পরিবহন ব্যবহার করছে।”
আরেক হেল্পার জসিম বলেন, “আগে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত বাস যেত, তখন যাত্রী উঠা-নামা সহজ ছিল। এখন ডাইভারশন দিয়ে রাস্তাটা ঘুরিয়ে দিয়েছে। এতে সময়ও বেশি লাগছে, জ্বালানিও খরচ হচ্ছে বেশি।”
শুধু রাস্তায় যানজট নয়, ফুটপাতও এখন দখল হয়ে গেছে হকারদের হাতে। ফলে মানুষ হাঁটতেও পারছে না। পথচারীরা অভিযোগ করেছেন, সড়কে যানজটের কারণে তারা ফুটপাত ব্যবহার করতে গেলেও সেটিও বন্ধ—এদিকে হকাররা বসে আছে দোকান সাজিয়ে।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা আফরোজা খানম বলেন, “গাড়ি চলে ধীরে, ফুটপাত দিয়ে হাঁটাও অসম্ভব। স্কুলে বাচ্চাকে নিতে যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগে। এই এলাকায় যেন কেউ আর বাস করতে না চায়।”
ডিএমপির ট্রাফিক লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, “সদরঘাট এলাকার যানজট নিরসনেই আমরা এই ডাইভারশন শুরু করেছি। এতে কিছু জায়গায় ট্রাফিক বেড়েছে ঠিকই, তবে সামগ্রিকভাবে অনেক সুফলও মিলছে। আমরা যেসব জায়গায় সমস্যা হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিত করছি, দ্রুত সমাধান করা হবে।”
তিনি জানান, ধোলাইখালের ভাঙাচোরা রাস্তাগুলো সংস্কার করা গেলে গাড়ির গতি বাড়বে এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আসবে। “আমরা সিটি করপোরেশন ও সড়ক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করছি, যাতে ড্রেনেজ সমস্যা ও রাস্তা মেরামত দ্রুত সম্পন্ন হয়।”
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ডাইভারশন কেবল একটি অস্থায়ী সমাধান। মূল সমস্যা হলো শহরের রাস্তাগুলোর নকশা, যানবাহনের সংখ্যা এবং ফুটপাতের দখল।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সামছুল হক বলেন, “ডাইভারশন তখনই কার্যকর হয় যখন বিকল্প রাস্তাগুলো প্রশস্ত ও চলাচলের উপযোগী হয়। কিন্তু ঢাকায় অনেক রাস্তাই সরু, সেখানে নতুন রুট চালু করা মানেই সংকট বাড়ানো।”
তিনি আরও বলেন, “ডিএমপি যদি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা না নেয়, তবে এই ডাইভারশনগুলো শহরের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে। যানজট কমানোর পাশাপাশি ফুটপাত মুক্ত করা ও গণপরিবহনকে অগ্রাধিকার দেওয়াই হওয়া উচিত মূল কৌশল।”
গত সাত মাসে ডিএমপির ৭০টি ডাইভারশন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি সাহসী প্রচেষ্টা। তবে এর সফলতা নির্ভর করছে কতটা বাস্তবসম্মতভাবে তা বাস্তবায়িত হয় তার ওপর। নগরবাসীর প্রত্যাশা—শুধু রুট পরিবর্তন নয়, বরং সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ঢাকা যেন পায় একটুখানি স্বস্তির শ্বাস।
যানজটমুক্ত রাজধানীর স্বপ্ন এখনও অনেক দূরে, কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, সহযোগিতা ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে সেই স্বপ্ন একদিন বাস্তবও হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



