ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণভোট এমন একটি শব্দ, যা নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে প্রায় অচেনা। ৩৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দেশে কোনো গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। অথচ একসময় এটি ছিল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ইতিহাস বলছে, স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে—১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে। এর মধ্যে প্রথম দুটি ছিল মূলত তৎকালীন ক্ষমতাসীন সামরিক শাসকদের প্রতি ‘আস্থা ভোট’, আর তৃতীয়টি ছিল একটি ঐতিহাসিক সাংবিধানিক রূপান্তরের অংশ—রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় রূপান্তর।
এখন, রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ও “জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫” ঘোষণার পর, আবারও দেশে চতুর্থ গণভোট আয়োজনের আলোচনা শুরু হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সর্বশেষ সুপারিশ অনুযায়ী, এই গণভোটের বিষয় হবে সংবিধান ও আইনি সংস্কার অনুমোদন—অর্থাৎ জনগণের প্রত্যক্ষ মতামতের মাধ্যমে নতুন সাংবিধানিক কাঠামোর বৈধতা অর্জন।
সাধারণ নির্বাচনে ভোটাররা প্রার্থী, প্রতীক বা রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন। কিন্তু গণভোটের ক্ষেত্রে প্রার্থী থাকে না—থাকে শুধু একটি প্রশ্ন, যার জবাবে ভোটার ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলেন। এই প্রশ্ন সাধারণত রাষ্ট্রীয় কোনো বড় সিদ্ধান্ত, সংবিধান পরিবর্তন, নতুন আইন প্রণয়ন বা শাসনব্যবস্থা নির্ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমত জানার জন্য তৈরি করা হয়।
জাতিসংঘের সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত নথিতে বলা হয়েছে, সংবিধান সংশোধন বা গ্রহণের ক্ষেত্রে গণভোটকে গণতান্ত্রিক বৈধতার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৮০-এর দশকের শেষ নাগাদ বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি সংবিধানে কোনো না কোনোভাবে গণভোটের বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল।
একটি সহজ উদাহরণ ধরা যাক—ধরা যাক, কোনো দেশে একাধিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী আছে। সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে দাপ্তরিক কাজে একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে, তবে সে বিষয়ে গণভোট আয়োজন করা হতে পারে। জনগণ যেই ভাষার পক্ষে ভোট দেবে, সেটিই সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
বাংলাদেশে গণভোটের ধারণা আসে পাকিস্তান আমল থেকে। রাজনৈতিক ইতিহাসবিদদের মতে, ‘হ্যাঁ–না’ ধরনের ভোটের প্রচলন শুরু করেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান। পরে বাংলাদেশেও এই প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে গণভোটের বিধান যুক্ত হয় ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। তবে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই বিধান বাতিল করা হয়। চলতি বছরের জুলাই মাসে হাইকোর্টের এক ঐতিহাসিক রায়ে পুনরায় সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে থাকা গণভোটের বিধান পুনর্বহাল করা হয়। ফলে নতুন করে গণভোট আয়োজনের সাংবিধানিক পথ তৈরি হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সম্প্রতি “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫”–এর দুটি খসড়া প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে। তাতে গণভোটের প্রশ্নটি নির্ধারণ করা হয়েছে এভাবে— “আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তপশিল-১-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?”
অর্থাৎ ভোটারদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলার মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের খসড়া প্রস্তাবের প্রতি জনসমর্থন যাচাই করা হবে।
তপশিল-১ এ অন্তর্ভুক্ত ৪৮টি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে— সংবিধানের মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ও তাঁর ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদসীমা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন, নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ইত্যাদি।
উদাহরণস্বরূপ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে প্রস্তাবে বলা হয়েছে—“একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন।” অর্থাৎ একজন ব্যক্তি দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
যেহেতু বর্তমানে সংসদ নেই, তাই সরকার বিশেষ ‘আদেশ’ জারি করে গণভোট আয়োজনের ক্ষমতা পাবে। খসড়া আদেশে বলা হয়েছে— “সরকার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে এই আদেশ জারি করিল।”
অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারই বিশেষ আদেশের মাধ্যমে গণভোটের সময়, পদ্ধতি ও প্রশ্ন নির্ধারণ করবে।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে পরবর্তী সংসদ হবে “সংবিধান সংস্কার পরিষদ”, যারা ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করবে।
জুলাই জাতীয় সনদের মোট সংস্কার প্রস্তাব ৮৪টি, তবে ঐকমত্য কমিশন ভিন্নমতযুক্ত প্রস্তাবগুলো বাদ দিয়েছে। এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “ভিন্নমত থাকা প্রস্তাব বাদ দেওয়া প্রতারণা। কমিশন নিরপেক্ষতা হারিয়েছে।”
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদও কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিশনের খসড়াকে স্বাগত জানিয়েছে। দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “আইনি ভিত্তিসম্পন্ন আদেশের খসড়া গ্রহণ হলে সনদ বাস্তবায়নের পথ আরও সুগম হবে।”
বাংলাদেশের তিনটি ঐতিহাসিক গণভোট
প্রথম গণভোট – ১৯৭৭
প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানবলে গণভোটের ঘোষণা দেন। ৩০ মে অনুষ্ঠিত সেই ভোটে জনগণের সামনে ছিল দুটি বাক্স—একটিতে ‘হ্যাঁ’, অন্যটিতে ‘না’।
ফলাফল:
‘হ্যাঁ’ ভোট—৯৮.৯৭%
‘না’ ভোট—১.৩%
বিষয়: রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচির প্রতি জনগণের আস্থা।
দৈনিক বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এটি ছিল মূলত জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি গণআস্থার প্রতিফলন।
দ্বিতীয় গণভোট – ১৯৮৫
২১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ঘোষিত দ্বিতীয় গণভোট। এতে মূল প্রশ্ন ছিল—এরশাদের নীতি ও প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর অবস্থান নিয়ে জনগণের মতামত।
ফলাফল:
‘হ্যাঁ’ ভোট—৯৪.১৪%
‘না’ ভোট—৫.৫%
এই ভোটের আগে সব রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়, এবং তখনকার বিরোধী জোটের দুই নেত্রী—শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয়।
তৃতীয় গণভোট – ১৯৯১
১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ গণভোট। উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে রূপান্তর।
ফলাফল:
‘হ্যাঁ’ ভোট—৮৪.৩৮%
‘না’ ভোট—১৫.৬২%
এই ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে সূচিত হয় এক নতুন অধ্যায়—সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন।
অ্যাডভোকেট এবিএম রিয়াজুল কবীর কাওছারের গ্রন্থ ‘আইন বিধিমালা তথ্য ও ফলাফল: বাংলাদেশ নির্বাচন (১৯৪৭–২০২৩)’ অনুযায়ী—
১৯৭৭ সালের গণভোটে ভোট পড়েছিল ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭৬৮ (ভোটার উপস্থিতি ৮৮.০৫%)
১৯৮৫ সালের গণভোটে ভোট পড়েছিল ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৭২ হাজার ৫১৪ (ভোটার উপস্থিতি ৭২.১৫%)
১৯৯১ সালের গণভোটে ভোট পড়েছিল ২ কোটি ১৮ লাখ ৮৮ হাজার ৪৩৭ (ভোটার উপস্থিতি ৩৫.১৯%)
অর্থাৎ, যত বেশি জনগণ বিষয়টি বুঝেছেন, অংশগ্রহণের হার তত কমেছে—১৯৯১ সালের গণভোটে মানুষ বিষয়টি সম্পর্কে সবচেয়ে সচেতন ছিল, কিন্তু ভোট পড়েছিল তুলনামূলকভাবে কম।
বাংলাদেশে সর্বশেষ গণভোট হয়েছিল ১৯৯১ সালে। এরপর কেটে গেছে প্রায় সাড়ে তিন দশক। এই সময়ে রাজনীতি, সংবিধান, ও গণতান্ত্রিক চর্চায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন নতুন করে গণভোট আয়োজনের আলোচনা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করা হতে পারে। এটি শুধু সংবিধান সংস্কার নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নাগরিক অংশগ্রহণের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা।
সংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশের গণভোটের ইতিহাস শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়—এটি প্রতিবারই ক্ষমতার বৈধতা, জনগণের আস্থা, আর সাংবিধানিক রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি হয়ে থেকেছে। আর এবার, যদি চতুর্থ গণভোট সত্যিই অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা হবে এক নতুন প্রজন্মের হাতে গণতন্ত্র ও সংবিধান সংস্কারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ঐতিহাসিক সুযোগ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



