ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক মাঠে ততই তাপমাত্রা বাড়ছে। জোট, মহাজোট, আসন সমঝোতা, স্বতন্ত্র অবস্থান—সব মিলিয়ে চলছে এক অদ্ভুত রাজনৈতিক অঙ্কের খেলা। দীর্ঘদিন পর এই নির্বাচনে তরুণদের গড়া নতুন রাজনৈতিক শক্তি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক হিসাবের কেন্দ্রে। বিএনপি চায় তাদের পাশে রাখতে, জামায়াতও ছাড়তে রাজি নয়। এমতাবস্থায়, কে কাকে পাবে—এই প্রশ্ন এখন দেশের রাজনীতির বড় আলোচ্য বিষয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে রাজনীতির গতিপথ পাল্টে যায়। ক্ষমতার পালাবদলের পর নতুন মেরুকরণে পুরোনো জোটগুলো ভেঙে যায়, নতুন শক্তির উত্থান ঘটে। এই সময়েই আবির্ভাব ঘটে তরুণদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব থেকে উঠে আসা এই দলটি এখন জাতীয় রাজনীতির সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে।
দলের আত্মপ্রকাশের পর থেকেই বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দিকে হাত বাড়ায়। কারণ, এনসিপির রয়েছে এক বিশাল তরুণ ভোটব্যাংক—যারা ২০২৫ সালের নির্বাচনে ভোটারদের একটি বড় অংশ হতে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপির আদর্শিক অবস্থান তুলনামূলকভাবে উদার এবং সংস্কারমুখী। তাদের রাজনৈতিক ভাষ্য “পরিবর্তন” এবং “নাগরিক ক্ষমতায়ন”—যা বিএনপির গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি এবং জামায়াতের ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দর্শনের মাঝামাঝি অবস্থানে দাঁড়ায়। ফলে, উভয় দলই মনে করে এনসিপি-কে সঙ্গে রাখলে নির্বাচনি মাঠে বাড়বে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থন।
বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী—দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র। ১৯৯৯ সালে গঠিত চারদলীয় জোটের অংশ হিসেবে তারা একাধিক নির্বাচনে একসঙ্গে লড়েছে, এমনকি ২০০১ সালের নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে সরকারও গঠন করেছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই সম্পর্ক অনেকটাই ভেঙে গেছে।
চব্বিশের পরবর্তী সময়ে জামায়াত ইসলামী তাদের রাজনৈতিক কৌশল পাল্টে নেয়। তারা বিএনপি থেকে দূরত্ব তৈরি করে এবং নিজেদের স্বাধীন রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়। একদিকে বিএনপি চায় আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা; অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তা তাদের জন্য বাধা হতে পারে বলে মনে করছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব।
অন্যদিকে, জামায়াতও এখন সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতার দিকে তাকিয়ে। তারা সংসদে বিরোধী দল বা অন্তত প্রভাবশালী অবস্থানে থাকার কৌশল নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির সঙ্গে তাদের মতপার্থক্য আরও গভীর হয়—বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদ, গণভোট, সংবিধান সংস্কার, এবং উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব ইস্যুতে।
বিএনপির এখন প্রধান লক্ষ্য হলো তরুণ ভোটারদের আস্থা ফিরে পাওয়া। এ কারণেই তারা এনসিপির সঙ্গে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চাইছে। দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, “এনসিপি এখন মাঠের সবচেয়ে আলোচিত শক্তি। তাদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তুলতে পারলে আমরা নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মের ভোট পেতে পারব।”
সূত্র জানায়, বিএনপি ঢাকাসহ অন্তত ২০টি আসনে এনসিপির জন্য প্রার্থিতা ছাড়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া, সরকার গঠিত হলে মন্ত্রিসভায় এনসিপি প্রতিনিধিত্ব পাবে—এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে।
তবে বিএনপির শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে এসব নিয়ে মুখ খোলেননি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এনসিপির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে, কিন্তু জোটবদ্ধ হবো কি হবো না সেটা এখনই বলা যাবে না। রাজনীতির মাঠেই সিদ্ধান্ত হবে।”
এদিকে, জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকেও এনসিপিকে কাছে টানার চেষ্টা চলছে। দলটির কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এনসিপি নেতৃত্বের সঙ্গে একাধিকবার অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন।
অধ্যাপক পরওয়ার বলেন, “আমরা এনসিপিকে নিয়ে জোট করব—এমন কোনো ঘোষণা দিইনি। তবে রাজনৈতিক যোগাযোগ সব সময়ই থাকে। ইসলামি মূল্যবোধ ও গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে তারা আমাদের সমমনা।”
তবে, এনসিপির পক্ষ থেকে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার ইঙ্গিত আগেই দেওয়া হয়েছে। দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমাদের অবস্থান স্পষ্ট—ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে নয়, নাগরিক অধিকারের রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি।” এই বক্তব্যের পর জামায়াত নেতারা প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন, ফলে সম্পর্ক আরও শীতল হয়ে যায়।
এনসিপির ভেতরে এখনো জোট রাজনীতি নিয়ে মতানৈক্য আছে। দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, “আমরা কোনো দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক জোটে না গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে। তবে অভিন্ন এজেন্ডা বা সংস্কারমূলক লক্ষ্য থাকলে তা নিয়ে বোঝাপড়া হতে পারে।”
অন্যদিকে, দলের এক যুগ্ম আহ্বায়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বিএনপি–জামায়াত উভয় পক্ষই এখন এনসিপিকে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। “আমরা যেভাবেই এগোই না কেন, জামায়াতের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক জোটে না যাওয়ার ব্যাপারে বিএনপির প্রবল চাপ আছে,” বলেন তিনি।
এনসিপির সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক জটিল হয়ে ওঠে জুলাই জাতীয় সনদ ইস্যুতে। দলটি সনদে আইনি ভিত্তি না থাকার কারণ দেখিয়ে স্বাক্ষর করেনি। পরবর্তীতে গণভোট, উচ্চকক্ষ গঠন, এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা ইত্যাদি প্রস্তাবেও তাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে আলাদা ছিল।
এই মতপার্থক্যের জের ধরেই উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্যের প্রতি এনসিপি পক্ষপাতের অভিযোগ তোলে। এরপর থেকেই এনসিপি কিছুটা দূরত্বে চলে যায় বিএনপি ও জামায়াত উভয়ের কাছ থেকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহফুজ রশীদ বলেন, “এনসিপি এখন ‘কিংমেকার’-এর ভূমিকায়। তারা যদি বিএনপির সঙ্গে যায়, তা হলে তরুণ ভোটারদের ভোট একদিকে যাবে। আবার জামায়াতের সঙ্গে গেলে ইসলামী ভোট ব্যাংকে পরিবর্তন আসবে।”
তিনি আরও বলেন, “তবে এনসিপির বড় চ্যালেঞ্জ হলো আদর্শগত সামঞ্জস্য বজায় রেখে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া। তরুণদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করলেও, তাদের রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বৃহৎ জোটের সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই হবে।”
এখনও নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়নি। ফলে জোট ও আসন সমঝোতার আলোচনাগুলো অনেকটাই প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে বিএনপি–জামায়াত উভয় শিবিরেই এখন এনসিপি নিয়ে কৌতূহল ও দৌড়ঝাঁপ চলছে।
সূত্র অনুযায়ী, এনসিপি ইতোমধ্যেই তৃণমূলে বার্তা পাঠিয়েছে যে তারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত। তবে অভিন্ন সংস্কার এজেন্ডার ভিত্তিতে কিছু নির্বাচনি সমঝোতা হতে পারে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরছে— বিএনপি না জামায়াত—শেষ পর্যন্ত কার সঙ্গে যাবে এনসিপি?
উত্তর মিলবে খুব শিগগিরই, যখন তফসিল ঘোষণার পর আসন বণ্টনের বাস্তব চিত্র সামনে আসবে। ততদিন পর্যন্ত এনসিপি থাকবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, আর রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পাশে টানার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



