ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় সরকার প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও নির্বাচনী কার্যক্রমে মনোযোগ ধরে রাখতে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত ‘একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত’ কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বিদেশ সফরে না যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। সর্বশেষ জারি করা পরিপত্রে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এ নির্দেশ অমান্য করলে তা প্রশাসনিক অনিয়ম হিসেবে বিবেচিত হবে।
সরকারের এই নির্দেশনার লক্ষ্য হলো—নির্বাচনের আগে ও চলাকালীন সময়ে প্রশাসনের কার্যক্রমে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, মাঠপর্যায়ে নির্বাচন সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনে কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং বিদেশ সফরের নামে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের লাগাম টানা।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত পরিপত্রে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের উপদেষ্টা, সচিব ও সিনিয়র কর্মকর্তারা পূর্বে দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ না করে বিদেশ সফরের অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন।
পরিপত্রে বলা হয়, “বৈদেশিক সফর সংক্রান্ত পূর্ববর্তী পরিপত্রগুলোর নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও সচিব একই সময়ে বিদেশ সফরে যাচ্ছেন, এমনকি একই মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা একযোগে বিদেশে অবস্থান করছেন। এসব প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে, যা পূর্বে জারি করা সরকারি নির্দেশনার পরিপন্থী।”
এ কারণে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় নতুন করে নির্দেশ জারি করেছে যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত কেবলমাত্র একান্ত অপরিহার্য কারণ ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তা বিদেশ সফরে যেতে পারবেন না।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরিপত্রে আগের নির্দেশনাগুলোর উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিদেশ সফর সীমিতকরণের বিষয়ে এর আগে অর্থ বিভাগও ২০২৫ সালের ৮ জুলাই একটি স্মারক জারি করেছিল, যেখানে বাজেট বাস্তবায়ন, ব্যয় সংযম ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সচল রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর মধ্যে অনেকেই এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিয়মিত বিদেশ সফরের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সফরের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও সরকারি কর্মকর্তা ব্যক্তিগত প্রকল্প বা প্রশিক্ষণের অজুহাতে বিদেশ গেছেন বলে জানা গেছে।
পরিপত্রে তাই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিদেশ সফরের বিষয়ে সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে অতিসতর্ক থাকতে হবে। প্রশাসনিক কাঠামোর কোনো স্তরেই একাধিক কর্মকর্তা একই সময়ে বিদেশে থাকতে পারবেন না।”
অধিকাংশ প্রশাসনিক বিশ্লেষক মনে করছেন, সরকারের এই নির্দেশ আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনকে সম্পূর্ণভাবে মাঠে সক্রিয় রাখার অংশ। জাতীয় নির্বাচন একটি ব্যাপক প্রশাসনিক কার্যক্রম—যেখানে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভূমিকা অপরিহার্য।
ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচন উপকরণ সরবরাহ, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়, এবং নির্বাচনোত্তর প্রতিবেদন প্রস্তুতি—সবকিছুতেই প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি প্রয়োজন।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “নির্বাচনের আগে বিদেশ সফর সীমিত করার সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য মূলত সরকারি প্রশাসনকে নির্বাচনী কাজে শতভাগ সম্পৃক্ত রাখা। অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে অনেক কর্মকর্তাই বিদেশ সফরে থাকেন, যা মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে। এবার সরকার সে সুযোগ বন্ধ করছে।”
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরিপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এ নির্দেশ সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, সরকারি সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশন—সবার জন্য প্রযোজ্য হবে।
এতে উল্লেখ করা হয়, “আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের প্রধানরা যেন অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করেন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিদেশ সফরের প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো যাবে না।”
অর্থাৎ, বিদেশ সফরের জন্য এখন শুধু মূল দপ্তরের অনুমোদন নয়, বরং কেন্দ্রীয়ভাবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অনুমোদনও প্রয়োজন হবে।
বর্তমান আর্থিক প্রেক্ষাপটে সরকার ব্যয় সংযমে জোর দিচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ, উন্নয়ন ব্যয়ে অগ্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ, এবং প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এখন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, “বিদেশ সফর সীমিতকরণের নির্দেশ কেবল নির্বাচনী কারণে নয়, অর্থনৈতিক কারণেও তা গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। তাই সরকার চায় অপ্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় বন্ধ করতে।”
তিনি আরও বলেন, “বিদেশ সফর সাধারণত টিকিট, ভাতা ও আবাসন খরচের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় ঘটায়। এ ধরনের ব্যয় সীমিত করা এখন সময়ের দাবি।”
পূর্ববর্তী জাতীয় নির্বাচনের সময়ও প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা একসঙ্গে বিদেশ সফরে থাকায় মাঠপর্যায়ের দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন ঘটেছিল বলে অভিযোগ ওঠে। অনেক জেলায় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়া, লজিস্টিক সহায়তা পৌঁছাতে বিলম্ব এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা গিয়েছিল।
এবারের সরকার সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগেই সতর্ক হচ্ছে। এ কারণে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার এই নির্দেশ জারি করা হলো।
পরিপত্রে সতর্ক করা হয়েছে, নির্দেশনা অমান্য করলে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বিদেশ সফর সংক্রান্ত প্রস্তাবের ওপর এখন থেকে কঠোর নজরদারি করবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও অর্থ বিভাগ।
একই সঙ্গে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে বলা হয়েছে, কারা বিদেশ সফরে রয়েছেন এবং কারা আবেদন করেছেন, সে তালিকা নিয়মিতভাবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠাতে হবে। এতে প্রশাসনিক উপস্থিতি ও কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা হবে।
সরকারের সর্বশেষ এই নির্দেশনা নির্বাচনী প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রশাসনিক কর্মীদের মাঠে উপস্থিত রাখা, সরকারি কার্যক্রমে গতি বজায় রাখা, এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য।
নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় সরকার এখন আর কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। তাই “একান্ত অপরিহার্য কারণ ছাড়া বিদেশ সফর নিষিদ্ধ”—এই নির্দেশ কার্যত একটি প্রশাসনিক সতর্কবার্তা, যা নির্বাচনী শৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় মনোযোগকে পুরোপুরি দেশের ভেতরে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



