ছবি: সংগৃহীত
চলতি বছরের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক পণ্যের বাজারে মূল্যহ্রাসের ধারায় গতি এসেছে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, ২০২৫ সালে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য গড়ে ৭ শতাংশ কমবে, এবং ২০২৬ সালে আরও ৭ শতাংশ কমে যাবে—যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তর স্পর্শ করবে। এই দীর্ঘমেয়াদি মূল্যপতনের মধ্যেও বাংলাদেশের বাজারে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না; বরং দেশের ভোক্তারা এখনো উচ্চমূল্যের চাপে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার জন্য বাড়তি অর্থ গুনতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে—যা টানা কয়েক মাস ধরেই ৮ শতাংশের ঘরে অবস্থান করছে। বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য হ্রাসের সুফল দেশে পৌঁছাচ্ছে না মূলত টাকার অবমূল্যায়ন, উচ্চ শুল্ক কাঠামো, এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে।
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক: অক্টোবর ২০২৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য হ্রাসের সবচেয়ে বড় কারণ হলো জ্বালানির দাম পতন। বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় মূল্য ব্যাপকভাবে কমে এসেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম গত বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে।
ব্রেন্ট ক্রুড তেলের গড় দাম ২০২৫ সালে ব্যারেলপ্রতি ৬৮ ডলারে নেমে আসতে পারে, যা ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। আর ২০২৬ সালে এটি আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তেলের ব্যবহার কমে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক—চীনের তেলচাহিদার প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার, এবং বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার শক্তিশালী হয়ে ওঠা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৬ সালে বিশ্বে তেল সরবরাহ ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, কৃষিপণ্য ও খাদ্যপণ্যের বাজারেও ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। ২০২৫ সালে কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক মোটামুটি স্থিতিশীল থাকবে, আর ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ এবং ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
খাদ্যপণ্যের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো শস্য, ভোজ্যতেল, প্রোটিনজাত পণ্য ও অন্যান্য মৌলিক খাদ্যের দাম, যেগুলো সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তুলনামূলক স্থিতিশীল রয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদনে সাময়িক বিঘ্ন ঘটলে দাম কিছুটা ওঠানামা করতে পারে।
বিশেষ করে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম সাময়িকভাবে বেড়ে যায়, যদিও বছরের দ্বিতীয়ার্ধে তা আবার কমতে শুরু করে। বিশ্বব্যাংক মনে করছে, ২০২৬ সালে পানীয় পণ্যের দাম ৭ শতাংশ এবং ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে সয়াবিন বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত চীনে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন রপ্তানি করে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে কম দামে সয়াবিন বিক্রি করতে অন্য বাজারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০২৬ ও ২০২৭ সালে সয়াবিনের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমে যেতে পারে, কিন্তু ব্রাজিল তার উৎপাদন আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে—যা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক বাজারে প্রভাব ফেলবে।
২০২৫ সালে বিশ্ববাজারে সারের দাম ২১ শতাংশ বেড়েছে—যা খাদ্য উৎপাদন খরচে নতুন চাপ সৃষ্টি করছে। সারের দামে এই বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা, পরিবহন সংকট এবং কিছু অঞ্চলে সরবরাহ ঘাটতি।
যদিও ২০২৬ ও ২০২৭ সালে সারের দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবুও ২০১৫–১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর অন্যতম কারণ হলো উৎপাদন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
বিশ্বব্যাংক জানায়, চীন নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, আর পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে। এছাড়া রাশিয়া ও বেলারুশ উভয় দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের মুখে পড়েছে, যা বিশ্ববাজারে সারের দাম স্থিতিশীল হতে বাধা দিচ্ছে।
বিশ্ববাজারে ধারাবাহিক দরপতন হলেও বাংলাদেশের বাজারে তার কোনো ইতিবাচক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “মূলত বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, টাকার অবমূল্যায়ন, এবং উচ্চ শুল্ক কাঠামোর কারণে আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল সাধারণ ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের বাজারে তথ্যের অভাব রয়েছে—কোন পণ্যের কত চাহিদা, কখন আমদানি করা উচিত, বা কোন সময়ে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেবে—এসব বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনার অভাব আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না, সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়, এবং দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যায়।”
এ ছাড়া দেশে অনেক পণ্য আমদানি হলেও সেগুলোর স্থানীয় উৎপাদনও রয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাজারের সরবরাহে।
সার্বিকভাবে দেখা যায়, ২০২৬ সালে যখন বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামবে, তখনো বাংলাদেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি উচ্চ থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, এবং বাজার তদারকির দুর্বলতা—সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের স্বস্তির হাওয়া এখনো দেশের ভোক্তার ঘরে পৌঁছায়নি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিশ্ববাজারে দরপতনের এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে এখনই আমদানি ব্যবস্থাপনা, মুদ্রানীতি ও বাজার তদারকির সমন্বিত সংস্কার জরুরি। নইলে ২০২৬ সালেও বাংলাদেশের বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের ভোগান্তি কমার সম্ভাবনা নেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



