ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর সংশ্লিষ্ট একটি অর্ধসরকারি চিঠিতে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব স্বায়ত্তশাসনকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে ব্যাপক আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কার প্রস্তাব করেছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত ৯ অক্টোবর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে প্রেরিত চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ সংশোধনের পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। সংশ্লিষ্ট চিঠিতে সংশোধনীর খসড়া নীতিগতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং এটি সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
চিঠি অনুযায়ী, সংশোধনীয় বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে: গভর্নরের মর্যাদা বাড়ানো, পরিচালনা পর্ষদের পুনর্গঠন, শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও অপসারণ প্রক্রিয়ায় সন্দেহ-বিহীন মেকানিজম সৃষ্টি, হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা, একচেটিয়া কার্যকলাপ প্রতিরোধ ও ক্রেডিট রেটিং সংস্থার তদারকি বাড়ানো। এসব প্রয়াস মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রেখে, সীমাহীন নীতি নির্ধারণ ও তদারকির ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া উদ্দেশ্যেই আনা হয়েছে।
চিঠিতে গভর্নর মনসুর প্রস্তাব করেছেন যে, শীর্ষ নিয়োগ (গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর) সংক্রান্ত ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হোক — উদাহরণস্বরূপ, একজন সাবেক অর্থ বা পরিকল্পনা মন্ত্রী অথবা সাবেক গভর্নরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি। তারপর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মেধাভিত্তিক ও নিরপেক্ষ পন্থা অনুসরণ করতে হবে।
এছাড়া, অপসারণের ক্ষেত্রে একটি তিন সদস্যের তদন্ত আদালত গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যাতে শীর্ষ কর্মকর্তাদের অপসারণ কেবলমাত্র “আইনানুগ প্রক্রিয়া” এবং “উচিত কারণ” থাকলে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, যেভাবে Bank of England-এ কোনো কর্মকর্তা অপসারণের ক্ষেত্রে অসদাচরণ বা অক্ষমতার প্রমাণ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক।
এভাবে নিয়মিত নিয়োগ-অপসারণ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক চাপ, ভ্রষ্টাচার বা স্বজনপ্রীতির সুযোগ কমিয়ে আনা হবে — যা মূলত একটি আধুনিক ও স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌলিক শর্ত, বলে চিঠিতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরিচালনা পর্ষদের গঠন আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। বর্তমানে পর্ষদে রয়েছে গভর্নর, এক জন ডেপুটি গভর্নর, তিনজন সচিব, দুজন অর্থনীতিবিদ ও একজন ব্যবসায় সংগঠনের প্রতিনিধি। প্রস্তাব অনুযায়ী, সরকারের নিয়ুক্ত পরিচালক সংখ্যা তিন থেকে কমিয়ে আনা এবং স্বাধীন বিশেষজ্ঞ সদস্যের সংখ্যা চার থেকে ছয় করা হবে।
গভর্নরের পদমর্যাদা পূর্ণ মন্ত্রীর সমান করার প্রস্তাবও রয়েছে — যা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মতো দেশে দেখা যায়। এতে হবে নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও স্বাধীনতা, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব ও সম্বন্ধিত সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় শক্তিশালী হবে।
চিঠিতে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের জন্য বেশ কিছু নতুন তদারকি বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে:
-
হুইসেলব্লোয়ার (অভিযোগকারী কর্মকর্তা) সুরক্ষা নিশ্চিত করা;
-
একচেটিয়া/অধিকারভিত্তিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ;
-
ক্রেডিট রেটিং সংস্থার কার্যক্রম তদারকি বৃদ্ধি;
-
জামানত মূল্যায়ন ও আইনি যাচাই প্রসারিত করা।
এইসব ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ, স্বজনপ্রীতি, তথ্য গোপন, অসম নিয়োগ ও দুর্বল তদারকির সুযোগ কমিয়ে আনা যাবে — এবং ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে।
Transparency International Bangladesh-এর দৈনিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে “নিয়ম-নীতি, প্রশাসনিক ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাব” সংক্রান্ত বহু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তারা উল্লেখ করেছে, “রাজনৈতিক প্রভাব, নিয়োগ ও তদারকিতে সীমাবদ্ধতা, স্বচ্ছতার অভাব” মূল কারণ হিসেবে দেখা গেছে।
বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, প্রস্তাবিত এই সংশোধনীরা স্বায়ত্তশাসনের পথে বড় সোপান হতে পারে — তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা কতটা কার্যকর হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করবে গভর্নরের ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠান-সাধারণের মনোভাব, এবং সংশ্লিষ্ট সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গার ওপর।
অথর্মন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের অনুমোদন, আইনগত প্রক্রিয়া, সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণ কাঠামো পরিবর্তন—সব মিলিয়ে বাধা বেশি রয়েছে। বিশেষত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কমানোর ক্ষেত্রটি সবচেয়ে স্বেথ চ্যালেঞ্জ।
International Monetary Fund (IMF)-এর পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের জন্য মৌলিক সংস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে – “নিয়ন্ত্রক কাঠামোর শক্তিশালীকরণ, সরকারি মুদ্রানীতি স্বতন্ত্রভাবে নির্ধারণে সক্ষমতা” ইত্যাদি।
গভর্নর মনসুর নিজে দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, “আমরা ইতিমধ্যে বলেছি, বিদেশি তহবিল সহজভাবে না লাগলেও—স্বায়ত্তশাসন বাড়ানোর কাজ করব।”
এক্ষেত্রে একাধিক আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, একটি স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, মুদ্রানীতি নির্ধারণে দক্ষতা ও বাজার-আস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের জন্য সেটি এখন গুরুত্বপূর্ণ—বিশেষ করে মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ ও ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ দিক বিবেচনায়।
যাই হোক, এই সব প্রস্তাব বাস্তবায়নে বেশ বড় বাধা রয়েছে — যেমন:
-
সংশ্লিষ্ট আইন বা অধ্যাদেশ দ্রুত পাস করায় রাজনৈতিক রাজি থাকা;
-
শীর্ষ নিয়োগ ও অপসারণ প্রক্রিয়ায় স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ আইনগত কাঠামো;
-
স্বতন্ত্র তদন্ত বা অপসারণ প্রক্রিয়ায় বিচার-স্বাধীনতা বজায় রাখা;
-
তদারকির জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা ও মানবসম্পদ তৈরি করা;
-
প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (CPD)-র বিশ্লেষক মোস্তাফিজুর রহমান মন্তব্য করেছেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকৃত স্বাধীনতা নির্ভর করবে গভর্নরের ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা ও কর্মদক্ষতার ওপর। আইন হয়ে গেলেই সব শেষ হবে না; প্রয়োজনে তিনি এজন্য কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ—ইটাই আসল বিষয়।”
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ সংশোধনের খসড়া এবং আরও সংগৃহীত ৯ টি প্রস্তাব—এসবের মাধ্যমে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত ও রাজনৈতিক-প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করার যে দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছে, তা স্বাগত। তবে এ খবরটি একদিকে যেমন ইতিবাচক, অন্যদিকে তেমনি এটি একটি বড় ‘রোলআউট’—যার সফল বাস্তবায়নের জন্য আইন, প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও জনসাধারণের আস্থা—সব মিলিয়ে কাজ করতে হবে।
আগামী দিনগুলোতে দেখা যাক — সরকার কত দ্রুত এসব প্রস্তাবে রাজি হয়, সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশ বা আইন পাস হয়, এবং সেই অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যক্রমে কতটা স্বাধীন হয়। আপনার যদি বিশেষ কোনো সংশোধনী বা আইন-খসড়া সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা হয়, আমি তা অনুসন্ধান করে বিশ্লেষণ করতে পারি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



