ছবি: সংগৃহীত
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রধান কার্যালয়ে হঠাৎ অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রবিবার (২ নভেম্বর) সকাল থেকেই দুদকের তিন সদস্যের একটি দল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত সংস্থাটির ভবনে প্রবেশ করে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালায়। অভিযানের পেছনে রয়েছে বিদেশি মেলায় অংশগ্রহণকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ডলারে ঘুষ নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ—যা দীর্ঘদিন ধরে ইপিবির অভ্যন্তরীণ তদন্তেও প্রমাণিত হলেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণে গড়িমসি চলছিল।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ইপিবির এক উপপরিচালকের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের আগস্টে চীনের কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশ নেওয়া ১৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ১৫০ মার্কিন ডলার করে আদায় করার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ অনুযায়ী, ওই অর্থ ‘জামানত’ বাবদ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সংস্থার অনুমোদন ছাড়াই। পরে এ অর্থের কোনো রসিদ বা অফিসিয়াল নথি পাওয়া যায়নি।
২০২৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়—“ডলারে ঘুষ নেন ইপিবির এক কর্মকর্তা” শিরোনামের প্রতিবেদন। প্রকাশের পর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইপিবির উপপরিচালক পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি মেলায় অংশ নেওয়া উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করে আসছিলেন। মেলায় স্থান বরাদ্দ, বুথ অনুমোদন, এবং সরকারি ভর্তুকি সুবিধা পেতে হলে এসব অর্থ দিতে হতো বলেও অভিযোগে জানানো হয়।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইপিবি তৎক্ষণাৎ তিন সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান ছিলেন ইপিবির এক যুগ্ম পরিচালক, সঙ্গে ছিলেন একজন সহকারী পরিচালক ও একজন উপসহকারী পরিচালক। তাদের দায়িত্ব ছিল অভিযোগের সত্যতা যাচাই ও সংশ্লিষ্ট নথি পরীক্ষা করা।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। কমিটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে, উপপরিচালক নিয়মবহির্ভূতভাবে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১৫০ ডলার করে আদায় করেছেন, যা সরকারি নীতিমালার পরিপন্থী। প্রতিবেদনটি ইপিবির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে জমা দেওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে যায়, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক বা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং তিনি নিয়মিত দপ্তরে দায়িত্ব পালন চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ইপিবিতে এমন অনিয়ম বহু বছর ধরেই চলছে। বিশেষ করে বিদেশি মেলায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ঘুষের একটি অনানুষ্ঠানিক রীতি গড়ে উঠেছে। বহু কর্মকর্তা এর সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত।”
দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, শুধু কুনমিং মেলার ঘটনাই নয়, ২০১৭ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে ইপিবির একাধিক কর্মকর্তা একই পদ্ধতিতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে নেওয়া পে–অর্ডারগুলো মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর অফিসে জমা না দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ধরে রাখা হয়। কিছু ক্ষেত্রে এসব পে–অর্ডার ইস্যু হলেও তা পরে বাতিল করা হয়, ফলে সংশ্লিষ্ট অর্থের কোনো হিসাব থাকে না।
দুদক সূত্র আরো জানায়, ইপিবির সংশ্লিষ্ট উপপরিচালক ২০১৭ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন। ওই সময় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তিনি বিভিন্ন অজুহাতে বিদেশি মুদ্রায় অর্থ নিয়েছেন এবং কিছু অর্থ ব্যক্তিগতভাবে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
রবিবার সকালে দুদকের তিন সদস্যের দল হঠাৎ ইপিবি ভবনে প্রবেশ করে। তারা সরাসরি ওই উপপরিচালকের দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোতে তল্লাশি চালায়। অভিযানের সময় ইপিবির কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন। দুদক কর্মকর্তারা বিভিন্ন নথি, পে–অর্ডার এবং হিসাব সংক্রান্ত ফাইল খতিয়ে দেখেন।
অভিযানের পর ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের এক উপপরিচালকের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ ছিল। বিষয়টি খতিয়ে দেখতেই দুদকের একটি দল আমাদের কার্যালয়ে আসে। আমরা প্রয়োজনীয় সব তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছি। অনুসন্ধান এখনো চলছে।”
তবে অভিযান চলাকালীন উদ্ধার হওয়া নথি বা পে–অর্ডার সম্পর্কে দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। এক কর্মকর্তা বলেন, “তল্লাশিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করা হয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।”
দুদকের অভিযান নিয়ে ইপিবির কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার ফলে সংস্থার ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার কিছু কর্মকর্তা বলছেন, এই অভিযান দেরিতে হলেও প্রয়োজনীয় ছিল, কারণ বহু বছর ধরে অনিয়মকে ‘অফিস সংস্কৃতি’র অংশ বানানো হয়েছে।
একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, “আমরা চাই, দুদক যেন তদন্ত শেষ করে দ্রুত সত্যটা প্রকাশ করে। অনেক নিরপরাধ কর্মকর্তাও সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে যাঁরা দায়ী, তাঁদেরও বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।”
বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের বিদেশি বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণে ইপিবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংস্থাটিই বুথ বরাদ্দ, নীতিগত অনুমোদন, এবং সরকারপ্রদত্ত ভর্তুকির বিষয়টি পরিচালনা করে। কিন্তু অনেক উদ্যোক্তা অভিযোগ করেন, এসব সুযোগ পেতে হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘অতিরিক্ত সুবিধা’ দিতে হয়।
এক রপ্তানিকারক বলেন, “বিদেশি মেলায় অংশ নিতে হলে অফিসিয়াল ফি ছাড়াও আরও কিছু অর্থ দিতে হয়। না দিলে ফাইল ঝুলে থাকে, বা বুথ পাওয়া যায় না। আমরা বাধ্য হয়ে দিই।”
দুদক এখন প্রাথমিকভাবে ২০১৭ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ইপিবির বিদেশি মেলা সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করছে। সংস্থার এক পরিচালক জানিয়েছেন, প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং আর্থিক লেনদেনের তথ্য ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে যাচাই করা হবে।
দুদক কর্মকর্তাদের ধারণা, এই অনুসন্ধান শুধুমাত্র একজন উপপরিচালকের মধ্যেই সীমিত থাকবে না; বরং পুরো ইপিবির বিদেশি মেলা ব্যবস্থাপনায় একটি দুর্নীতির নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, যা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে।
ইপিবিতে এই অভিযান শুধু একটি নির্দিষ্ট অভিযোগ নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রশাসনিক উদাসীনতা, জবাবদিহির অভাব এবং আর্থিক অনিয়মের প্রতিফলন। দুদকের হঠাৎ অভিযান ইঙ্গিত দিচ্ছে, সংস্থাটি এখন রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে।
দুদকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চাই না, কিন্তু জনগণের টাকা ও দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতেই হবে।”
এখন সবার দৃষ্টি দুদকের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে—এই অভিযান কি শুধু ইপিবির একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত সীমিত থাকবে, নাকি গোটা সংস্থার অভ্যন্তরে থাকা দুর্নীতির শিকড় পর্যন্ত পৌঁছাবে—সেই প্রশ্নই এখন রপ্তানি খাতের অন্দরমহলে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



