ছবি: সংগৃহীত
সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশার—যে শহর একসময় ছিল কৃষি, বাণিজ্য ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র—আজ তা পরিণত হয়েছে এক ভয়াবহ মৃত্যুপুরীতে। রাস্তায় ছড়িয়ে আছে শত শত লাশ, ভেসে বেড়াচ্ছে পচা গন্ধ। প্রতিদিনই নতুন নতুন গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের খবর আসছে সেখান থেকে। ১৮ মাস ধরে অবরুদ্ধ থাকা শহরটি গত ২৬ অক্টোবর সুদানের আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) দখল করার পর থেকে ভয়াবহ নৃশংসতা শুরু হয়।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, শহরটি দখলের পর থেকে অন্তত ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেছেন। যারা পালাতে পারেননি, তাদের অনেককেই হত্যা বা নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বহু পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, শিশু ও নারী নিখোঁজ।
এল-ফাশার ছিল উত্তর দারফুর অঞ্চলে সরকারি বাহিনীর শেষ ঘাঁটি। সেখানে প্রায় ৮ লাখেরও বেশি মানুষ বাস করতেন। শহরটি দখলের পর আরএসএফ বাহিনী নির্বিচারে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা শুরু করে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এখন পর্যন্ত। শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, হাসপাতাল ও বাজার লুটপাট করা হয়েছে।
সুদানি সংবাদমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, আরএসএফ বাহিনী বেসামরিক লোকজনের বাড়িঘর ঘিরে ধরে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। নারীদের পোশাক খুলে তল্লাশি চালানো, শিশুদের ধরে নিয়ে যাওয়া, এমনকি বৃদ্ধদের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
বেঁচে ফেরা মানুষেরা বলছেন, তারা “নরক থেকে বেঁচে ফেরা মানুষ”।
২৫ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আলখেইর ইসমাইল বলেন, “আমরা প্রায় ৩০০ জন একসঙ্গে পালানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু শহর ছাড়ার আগেই আরএসএফের লোকজন আমাদের ধরে ফেলে। আমার সৌভাগ্য, তাদের একজন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো পরিচিত ছিল, তাই আমাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বাকি সবাইকে চোখের সামনে হত্যা করা হয়।”
৬৫ বছর বয়সী ফাতিমা আবদুল রহিম, তার নাতি-নাতনিদের নিয়ে ৫০ কিলোমিটার দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে আসেন। তিনি বলেন, “পাঁচ দিন ধরে না খেয়ে হেঁটেছি। মাঝপথে অনেককে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি। যারা পড়ে যাচ্ছিল, তাদের আর কেউ সাহায্য করতে পারেনি।”
অন্যদিকে ২৬ বছর বয়সী এক নারী বলেন, তার স্বামী সন্তানদের বাঁচাতে মুক্তিপণ দিয়েছিলেন, “কিন্তু তারা টাকা নেওয়ার পরই আমার সামনে আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে।”
আরেক নারী তাহানি হাসান বর্ণনা দেন, “রাতের অন্ধকারে তিনজন আরএসএফ সদস্য বাড়িতে ঢোকে। তারা প্রথমে আকাশে গুলি ছুড়ে চিৎকার করে বলে ‘থামো’। তারপর আমাদের সবাইকে মারধর করে পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। আমি নারী হয়েও তাদের তল্লাশির শিকার হই।”
বেঁচে ফেরা এক বৃদ্ধ বলেন, বন্দিদের ট্রাকচাপা দিয়ে হত্যা করেছে আরএসএফের সৈন্যরা।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এল-ফাশারের চারদিক আরএসএফ পরিখা খনন করে ঘিরে ফেলেছে, যাতে কেউ পালাতে না পারে। শহরের প্রবেশপথগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। অনেক মানুষকে শহর ছেড়ে যাওয়ার সময় গ্রেফতার করা হচ্ছে, কেউ কেউ মুক্তিপণ দিয়েও বাঁচতে পারছেন না।
শহরের ভেতরে খাবার, পানি ও ওষুধের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। চিকিৎসা সেবা প্রায় বন্ধ। হাসপাতালগুলোর ভেতরেও মৃতদেহ জমে আছে। জাতিসংঘ বলছে, পুরো এলাকা এখন “মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্র”।
জাতিসংঘ, আলজাজিরা, বিবিসি ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এল-ফাশারের পরিস্থিতি এখন গাজা বা মারিউপোলের চেয়েও ভয়াবহ। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর ঘটনাটিকে “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” বলে অভিহিত করেছে।
ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র জানান, “এটি এক ধরনের সংগঠিত গণহত্যা। আরএসএফ বাহিনী শহর দখল করার পর বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। নারীরা ধর্ষিত, শিশুরা অপহৃত, বৃদ্ধদের হত্যা করা হচ্ছে। এটি মানবিক বিপর্যয়ের এক ভয়াবহ উদাহরণ।”
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আরএসএফের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত দাবি করেছে। সংস্থাগুলো বলেছে, শহরে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে হবে এবং বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হবে।
তাবিলা, নিয়ালা, জেনেইনা ও পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে এখন হাজারো বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। স্থানীয় প্রশাসন জানায়, প্রতিদিন শত শত মানুষ সীমান্তের দিকে রওনা হচ্ছে।
খাবার ও ওষুধের অভাবে শরণার্থী শিবিরে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) বলেছে, “এল-ফাশার থেকে যারা পালাচ্ছে, তারা সবাই শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তারা অনাহারে আছে, শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। শহরটিতে এখন কোনো মানবিক সরবরাহ পৌঁছানো সম্ভব নয়।”
দারফুরে ২০০৩ সালে শুরু হওয়া সংঘর্ষে প্রায় ৩ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং ২৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। এবার ইতিহাস যেন আবার ফিরে এসেছে। এল-ফাশারের এই গণহত্যা সেই ভয়াবহ স্মৃতিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পর্যবেক্ষকরা।
সুদানি বেসামরিক অধিকারকর্মী আদেল আব্দুল্লাহ বলেন, “বিশ্ব যখন গাজার দিকে তাকিয়ে আছে, দারফুরে একই ধরনের গণহত্যা ঘটছে। কিন্তু এখানে কোনো ক্যামেরা নেই, কোনো কণ্ঠ নেই।”
এখন প্রশ্ন একটাই—এল-ফাশারের লাশের শহর হয়ে যাওয়া কি থামানো যাবে?
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, যদি বিশ্ব এখনই পদক্ষেপ না নেয়, তবে দারফুর আবার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মঞ্চে পরিণত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
				.png)
.png)
.png)



