ছবি: সংগৃহীত
বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক পেরিয়ে গেলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না বাংলাদেশের রফতানি খাত। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের ধারাবাহিকতায় অক্টোবর মাসেও দেশের মোট রফতানি আয় হ্রাস পেয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ পণ্য রফতানি থেকে আয় করেছে মোট ৩৮২ কোটি ৩৮ লাখ মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে রফতানি আয় ছিল ৪১৩ কোটি ৭ লাখ ডলার।
এই তথ্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হলো যে, টানা তিন মাস ধরে দেশের রফতানি খাত নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মুখে রয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, যা মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশের উৎস, সেখানে অর্ডার হ্রাস, কাঁচামালের উচ্চমূল্য এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে সরাসরি।
ইপিবির তথ্যানুসারে, অক্টোবর মাসে তৈরি পোশাক বা রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) খাত থেকে রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ৩০১ কোটি ৯৯ লাখ ডলারে। গত বছরের একই সময় এ খাত থেকে আয় হয়েছিল ৩২৯ কোটি ৬৪ লাখ ডলার—অর্থাৎ বছরওয়ারি আয় কমেছে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
এই খাতের মধ্যে নিটওয়্যার রফতানি থেকে এসেছে ১৬৫ কোটি ৭৮ লাখ ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম। অপরদিকে ওভেন পোশাক রফতানি থেকে আয় হয়েছে ১৩৬ কোটি ২১ লাখ ডলার—যা ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা মুদ্রাস্ফীতি, খরচ বৃদ্ধি এবং মজুদ পণ্যের কারণে নতুন অর্ডার দিচ্ছেন ধীরগতিতে। এছাড়া ডলারের সংকট, এলসি খোলায় জটিলতা এবং বিদ্যুৎ–গ্যাস ঘাটতির কারণে স্থানীয় কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে রফতানির ওপর।
যদিও তৈরি পোশাক খাতের পারফরম্যান্স হতাশাজনক, তবে অন্যান্য কিছু খাতে কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
ইপিবি জানায়, হোম টেক্সটাইল খাতে রফতানি আয় বেড়েছে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবর মাসে যেখানে আয় ছিল ৬ কোটি ৩৫ লাখ ডলার, সেখানে চলতি বছরের অক্টোবর মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ২৪ লাখ ডলারে।
এছাড়া চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতেও দেখা গেছে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি। অক্টোবর মাসে এ খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছে ৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, চামড়া খাতে বৈশ্বিক চাহিদা ধীরে ধীরে ফিরছে এবং বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব ট্যানারি উৎপাদন বাড়ায় ইউরোপীয় বাজারে নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
তবে কৃষিপণ্য রফতানিতে অব্যাহত পতন দেখা যাচ্ছে। অক্টোবর মাসে কৃষিপণ্য রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ২২ লাখ ডলারে, যা গত বছরের ১১ কোটি ৩১ লাখ ডলারের তুলনায় ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং মান নিয়ন্ত্রণ জটিলতা এই খাতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, ওষুধ, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও কৃষিপণ্যসহ মোট ২৭ ধরনের পণ্য বিশ্ববাজারে রফতানি হয়েছে। এ সময় মোট রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬১৩ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সামগ্রিকভাবে রফতানি আয় ইতিবাচক থাকলেও অক্টোবর মাসে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যাংকিং খাতের ডলার সরবরাহ এবং আমদানি ব্যয় সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতাদের আগ্রহ পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের রফতানি আয় পূর্ণোদ্যমে বাড়বে না। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা বিক্রির প্রবৃদ্ধি এখনো দুর্বল, পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার ওঠানামার কারণে ক্রেতারা নতুন অর্ডারে সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
অর্থনীতিবিদ ড. মো. তোফায়েল আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের রফতানি মূলত দুটি খাত—নিটওয়্যার ও ওভেন পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। এই দুটি খাতেই ধারাবাহিকভাবে আয় কমছে। এখন সময় এসেছে রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানোর এবং প্রযুক্তি ও মানোন্নয়নে নতুন বিনিয়োগের।”
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার ইতোমধ্যে রফতানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে নীতি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) আলোচনাও ত্বরান্বিত করা হচ্ছে, যাতে ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের পরও শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বজায় থাকে।
বাংলাদেশের রফতানি খাত এখন একটি জটিল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে বৈশ্বিক মন্দার চাপ, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতা—দুটি মিলিয়ে শিল্পখাতে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। তবে ইতিবাচক দিক হলো, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বাজারে শীতকালীন মৌসুম ঘনিয়ে আসায় পোশাকের অর্ডার কিছুটা বাড়তে পারে।
বিজিএমইএ আশা করছে, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে অর্ডার পুনরুদ্ধার হলে বছরের শেষ প্রান্তিকে রফতানি আয় কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তবে এজন্য বিদ্যুৎ–গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ব্যাংকিং খাতে ডলার সংকট নিরসন জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবমিলিয়ে, অক্টোবর মাসের রফতানি পতন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সতর্ক সংকেত। টানা তিন মাস আয় কমে যাওয়া কেবল পরিসংখ্যান নয়—এটি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ভারসাম্য, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপরও চাপ বাড়িয়ে তুলছে। এখন জরুরি হয়ে উঠেছে রফতানি খাতের পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করার জন্য সমন্বিত নীতি ও বাস্তবসম্মত কৌশল গ্রহণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
				.png)
.png)
.png)



