ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়ছে, আর সেই সঙ্গে প্রার্থীদের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কার্যক্রম শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি জানিয়েছে—নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পেলে প্রার্থীদের জমা দেওয়া হলফনামায় উল্লেখিত সম্পদ, দায়-দেনা, ও আর্থিক তথ্য বিস্তারিতভাবে যাচাই-বাছাই করবে তারা।
দুদকের ভাষায়, এবার আর কোনো প্রার্থী যেন “মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর বা গোপন তথ্য” দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে না পারে, সে বিষয়ে কমিশন পুরোপুরি সতর্ক অবস্থানে আছে। অতীতে বহুবার এমন নজির পাওয়া গেছে যে, প্রার্থীরা তাদের হলফনামায় প্রকৃত আয়-সম্পদ গোপন করে ভোটার ও প্রশাসন উভয়কেই বিভ্রান্ত করেছেন।
রবিবার (৩ নভেম্বর) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়টি স্পষ্ট করেন কমিশনের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আক্তার হোসেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,
“নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রার্থীদের হলফনামায় উল্লেখ করা সম্পদ ও অর্থের তথ্য আমরা যাচাই করবো। প্রার্থীরা যেন মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিতে না পারেন, সে দিকেও দুদক সতর্ক রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, অতীতে দেখা গেছে অনেক প্রার্থী তাঁদের ঘোষণায় সম্পদের প্রকৃত তথ্য লুকিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ অপ্রদর্শিত সম্পদ দেখিয়ে নির্বাচনের পরে আলোচনায় এসেছেন। তাই এবার কমিশন চাইছে এমন জালিয়াতির কোনো সুযোগ যেন না থাকে।
দুদকের ডিজি জানান, “ইসির অনুরোধ এলে আমরা প্রার্থীদের হলফনামায় উল্লেখিত আয়-সম্পদের তথ্য যাচাই করব। প্রয়োজনে রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক, ভূমি রেকর্ড অফিস, ব্যাংক কোম্পানি বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তাও নেওয়া হবে। এছাড়া মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বা অভিযোগকেও তথ্যসূত্র হিসেবে বিবেচনা করা হবে।”
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, আগের নির্বাচনে বহু প্রার্থী—বিশেষ করে ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী রাজনীতিকরা—তাদের হলফনামায় ব্যাংক আমানত, স্থাবর সম্পদ, কিংবা বিদেশে থাকা বিনিয়োগের তথ্য গোপন করেছিলেন। এমনকি কেউ কেউ মামলাজনিত সম্পদ বা দেনার হিসাবই উল্লেখ করেননি।
২০১৮ সালের এক নির্বাচনে দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, অন্তত ৩৭ জন প্রার্থীর হলফনামায় গুরুতর অসঙ্গতি ছিল। কারও জমির মূল্য গড় বাজারমূল্যের তুলনায় কয়েক গুণ কম দেখানো হয়েছে, আবার কেউ দেখিয়েছেন ব্যাংকে মাত্র ৫০ হাজার টাকা—যেখানে প্রকৃত হিসাবে তার কোটি টাকার সম্পদ ছিল।
এ কারণে কমিশন এবার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে “প্রার্থীদের হলফনামা যাচাইয়ের জন্য বিশেষ সেল” সক্রিয় করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশনের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইসি চায় স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে। প্রার্থীদের আর্থিক তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে দুদকের সহায়তা নেওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যেই প্রাথমিক আলোচনায় এসেছে।
একজন নির্বাচন কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “হলফনামা শুধু একটি আনুষ্ঠানিক কাগজ নয়—এটি ভোটারদের কাছে প্রার্থীর সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতিফলন। যদি কোনো প্রার্থী মিথ্যা তথ্য দেন, তা আইনের আওতায় অপরাধ। দুদক যদি যাচাইয়ে যুক্ত হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটি আরও স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সরকার ইতোমধ্যেই প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা প্রস্তুতি শুরু করেছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোও প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় আছে।
অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলো—বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ন্যাশনাল কনজারভেটিভ পার্টি (এনসিপি) ও আরও কয়েকটি দল—নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই বিএনপি ২৩৭ আসনে তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে দুদকের এমন পদক্ষেপকে অনেকেই দেখছেন “নির্বাচনী স্বচ্ছতার নতুন যুগের সূচনা” হিসেবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি দুদক সত্যিই নিরপেক্ষভাবে প্রার্থীদের সম্পদ যাচাই করতে পারে, তাহলে ভোটারদের আস্থা বাড়বে এবং কালো টাকার রাজনীতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
বর্তমান নির্বাচনী আইনে প্রার্থীদের হলফনামায় তথ্য গোপনের শাস্তি হিসেবে রয়েছে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড এবং জরিমানা। তবে এই আইন অতীতে কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয়নি।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার কোনো প্রার্থী ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য গোপন করলে বা মিথ্যা তথ্য প্রদান করলে তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪–এর ২৬ ধারা অনুযায়ী “অবৈধ সম্পদ অর্জন” বা “তথ্য গোপন” অপরাধে মামলা দায়েরের সুযোগ থাকবে।
একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাই না নির্বাচনকালীন সময়ে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি হোক। তাই ইসির অনুমোদন পেলেই আমরা ডেটা অ্যানালাইসিস ও সম্পদ যাচাইয়ের কাজ শুরু করব। এতে অন্তত বড় অঙ্কের সম্পদ লুকানোর চেষ্টা বন্ধ হবে।”
স্বচ্ছতা আন্তর্জাতিক সংস্থার (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রার্থীদের হলফনামা যাচাইয়ের বিষয়টি বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। যদি দুদক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করতে পারে, তাহলে জনগণের আস্থা বাড়বে এবং নির্বাচনে অর্থনৈতিক দুর্নীতির জায়গা কমে আসবে।”
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচনে অংশ নিতে হলে প্রার্থীদের উচিত জনগণের কাছে তাদের সম্পদ, আয়, ও দায় স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। ভোটারদের জানার অধিকার আছে—কোন প্রার্থী কতটা স্বচ্ছ।”
সারসংক্ষেপে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে দুদকের এমন প্রস্তুতি দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। ইসি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানালে কমিশন কেবল কাগজপত্র নয়, প্রার্থীদের বাস্তব সম্পদ, ব্যাংক লেনদেন, এবং ব্যবসায়িক সংযোগও খতিয়ে দেখবে।
এভাবে “অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছ নির্বাচন” আয়োজনের যে লক্ষ্য নিয়েছে বর্তমান প্রশাসন—দুদকের এই উদ্যোগ সেটিকে কার্যকর রূপ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাবার্তা/এসজে
				.png)
.png)
.png)



