ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক ঐক্যমতের অভাব ও জোটভিত্তিক নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে তীব্র বিতর্কের মধ্যেই সরকার সোমবার (৪ নভেম্বর) গভীর রাতে নির্বাচন-সংক্রান্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)’ সংশোধনের অধ্যাদেশের গেজেট প্রকাশ করেছে। এই সংশোধনের ফলে এখন থেকে কোনো রাজনৈতিক জোটের সদস্য দল অন্য দলের নির্বাচনী প্রতীকে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে না—অর্থাৎ প্রতিটি দলকে নিজস্ব প্রতীকে প্রার্থী দিতে হবে।
এই পরিবর্তন কার্যত বাংলাদেশের জোটনির্ভর নির্বাচনী রাজনীতির এক যুগের ধারার সমাপ্তি ঘটাল, যা স্বাধীনতার পর থেকে বিশেষ করে ১৯৯১ সালের পর ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্ত দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি বড় ধরনের পুনর্গঠনের ইঙ্গিত বহন করছে।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সংশোধিত আরপিও অধ্যাদেশ অনুমোদনের পর সোমবার মধ্যরাতে গেজেট জারি করা হয়। তবে এর আগে এবং পরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একে ‘রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ’ বলে দাবি করেছে, যা বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবে দেখছে তারা।
অন্যদিকে, সরকারপন্থী দল ও কিছু ক্ষুদ্র রাজনৈতিক সংগঠন এই পরিবর্তনকে রাজনীতিতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করছে।
উপদেষ্টা পরিষদের ২৩ অক্টোবরের বৈঠকে আরপিও সংশোধনের খসড়া অনুমোদন পায়। প্রথমে বিএনপি জোটভিত্তিক প্রতীকের বিধান বন্ধের বিরোধিতা করলেও চূড়ান্ত অনুমোদনে সেই আপত্তি উপেক্ষিত হয়। পরবর্তীতে জামায়াত ও এনসিপিও তীব্র বিরোধিতা জানায়।
সংশোধিত অধ্যাদেশে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিককে সরাসরি প্রভাবিত করবে।
জোটভিত্তিক প্রার্থী নিষিদ্ধ: কোনো দল অন্য দলের প্রতীকে প্রার্থী দিতে পারবে না। সব দলকেই নিজস্ব প্রতীকে অংশ নিতে হবে।
ঋণখেলাপিদের অযোগ্য ঘোষণা: মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সাত দিন আগে থেকে ঋণখেলাপি হলে প্রার্থী হতে পারবেন না, এবং নির্বাচিত হয়ে মেয়াদকালে ঋণখেলাপি হলে তাঁর আসন শূন্য হবে।
পলাতক আসামির প্রার্থীতা নিষিদ্ধ: ফেরারি আসামিদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে।
‘না ভোট’ ফিরল আংশিকভাবে: কোনো আসনে যদি একক প্রার্থী থাকেন, ভোটাররা চাইলে ‘না ভোট’ দিতে পারবেন।
জামানত দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি: প্রার্থীদের জামানত ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
আইটি-ভিত্তিক পোস্টাল ভোটিং চালু: প্রবাসী বা অনুপস্থিত ভোটারদের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার সুযোগ যুক্ত হয়েছে।
এআই অপব্যবহার নির্বাচনী অপরাধ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) অপব্যবহার বা বিভ্রান্তিকর কন্টেন্ট তৈরি নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইসি’র নতুন ক্ষমতা: মনোনয়নপত্রে অসত্য তথ্য দিলে নির্বাচিত হওয়ার পরও কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারবে।
সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হিসেবে সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা: ফলে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনে জরিমানা বাড়ানো হয়েছে: ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা এবং দলীয় পর্যায়ে অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
আরপিও সংশোধনের পর রাজনৈতিক মহলে দুই বিপরীত অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিএনপি ও তাদের মিত্ররা একে গণতান্ত্রিক ঐক্যবিরোধী সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। এই পরিবর্তন জোট রাজনীতিকে দুর্বল করবে এবং নির্বাচনী সমঝোতার সুযোগ কমাবে।”
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান মন্তব্য করেন, “জোট করার উদ্দেশ্যই হলো ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। কিন্তু যদি প্রতিটি দলকে নিজ নিজ প্রতীকে লড়তে হয়, তাহলে জোট করে লাভ কী? এতে প্রচার ও সংগঠনের কার্যক্রম কঠিন হয়ে পড়বে।”
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন হলে রাজনীতিতে দায়বদ্ধতা বাড়বে। বড় দলের ছায়ায় ছোট দলগুলো সুযোগ নিয়ে নেয়—এখন সেটা আর সম্ভব হবে না।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার আরপিও সংশোধনের অধ্যাদেশ নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন,
“আমাদের কমিশনের দেওয়া সুপারিশের বড় অংশই উপেক্ষিত হয়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, আর্থিক স্বচ্ছতা, বিদেশি শাখা বিলুপ্তি এবং তৃণমূল পর্যায়ের প্রার্থী প্যানেল বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবগুলোও রাখা হয়নি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তাসমিয়া রহমান মনে করেন, “এই পরিবর্তন নির্বাচনী স্বচ্ছতার যুক্তিতে আনা হলেও, বাস্তবে এটি বিরোধী দলগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশেষ করে যারা জোটভিত্তিক কৌশলে নির্বাচনে অংশ নিতে চায়।”
নতুন আরপিও কার্যকর হওয়ায় নির্বাচন কমিশন এখন নতুন আচরণবিধি চূড়ান্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এবং আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন আইন অনুযায়ী এখন দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিনির্ভর যাচাই-বাছাই, ডিজিটাল হলফনামা যাচাই এবং আইটি-সাপোর্টেড ভোটিং পদ্ধতি চালুর কাজও দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।
ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা আইন, নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ বিধান আইন, ইসি সচিবালয় আইন, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষণ নীতিমালা, সাংবাদিক নীতিমালা—সবগুলো সংশোধন শেষ হয়েছে। আরপিও সংশোধনের গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে নির্বাচন সংস্কারের শেষ ধাপ সম্পন্ন হলো।
বিরোধী দলগুলো বলছে, এই পরিবর্তন ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে রাজনৈতিক মাঠকে পুনর্গঠন করার একটি পরিকল্পনা। অন্যদিকে সরকারের দাবি, এটি নির্বাচনী শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পদক্ষেপ।
তবে একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন— “রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া কোনো আইনই টেকসই হয় না। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন নয়, বরং বিভাজনই গভীর হতে পারে।”
আরপিও সংশোধনের গেজেট জারির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নির্বাচনী রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। এখন অপেক্ষা, এই পরিবর্তন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াবে, নাকি রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও তীব্র করবে—তা জানা যাবে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের মাঠেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



