ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কাস্টমস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার আহসান হাবিবের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদ বিবরণীতে মিথ্যা তথ্য প্রদানের অভিযোগে মামলা করেছে। প্রায় ৫৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের উৎস অজানা থাকায় তার বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়।
দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মামলাটি দায়ের করেন সংস্থার সহকারী পরিচালক সায়েদ আলম। বিষয়টি মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন ওই কার্যালয়ের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ। মামলাটি দায়ের হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ও কাস্টমস মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর আহসান হাবিবকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তী মাসে, অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর তিনি কমিশনে তার সম্পদের বিবরণী দাখিল করেন। সেখানে তিনি মাত্র ৯ লাখ ২৯ হাজার ৬১২ টাকার স্থাবর সম্পদ এবং ৫০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের কথা উল্লেখ করেন।
তবে দুদকের পরবর্তী অনুসন্ধানে দেখা যায়, আহসান হাবিব তার প্রকৃত সম্পদের বড় একটি অংশ গোপন করেছেন। যাচাই-বাছাই শেষে কমিশনের কর্মকর্তারা দেখতে পান, তার নামে ও দখলে প্রকৃতপক্ষে মোট ১ কোটি ৪৯ লাখ ৮৯ হাজার ৩৯৬ টাকার সম্পদ রয়েছে। অর্থাৎ ঘোষণার সময় তিনি প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ টাকার বেশি সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
দুদকের অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, এসব গোপন সম্পদের মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক জমা, নগদ অর্থসহ নানা বিনিয়োগ।
দুদকের তদন্তে আহসান হাবিবের নামে এক কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র পাওয়া যায়। এছাড়া সোনালী ব্যাংকে তার নামে ৩৩ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) এবং মেডিকেয়ার ডিপোজিট স্কিমে পাঁচ লাখ ৭২ হাজার টাকার জমা পাওয়া গেছে। তদন্তে আরও উঠে আসে, তার মেয়ের নামে পাঁচ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রও রয়েছে, যা তিনি তার সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেননি।
অভিযোগপত্রে দুদক জানিয়েছে, এসব অর্থের উৎস সম্পর্কে আহসান হাবিব কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার বেতনের আয়, পেনশন, এবং অন্যান্য বৈধ উৎস যাচাই করে দেখা গেছে, তার মোট বৈধ আয় প্রায় ৯০ লাখ ৭৮ হাজার ৯৮৫ টাকা। অথচ তার নামে পাওয়া সম্পদের পরিমাণ এই আয়ের তুলনায় ৫৯ লাখ টাকার বেশি। ফলে এই পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে অর্জিত বলে দুদক নিশ্চিত হয়।
এই অনিয়মের কারণে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। এই ধারাগুলো অনুযায়ী, সম্পদ বিবরণীতে মিথ্যা তথ্য প্রদান এবং বৈধ উৎস ছাড়া সম্পদ অর্জন—দুটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানের পরই মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন মামলাটি নিয়মিত তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং অভিযুক্তের ব্যাংক হিসাব, আর্থিক লেনদেন, পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের সম্পদ অনুসন্ধানের কাজ শুরু করা হয়েছে। তদন্তে যদি তার সম্পদের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়, তাহলে মামলায় অতিরিক্ত অভিযোগ যোগ করা হতে পারে।
আহসান হাবিব ১৯৮০ সালে কাস্টমস বিভাগে ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘ সরকারি চাকরিজীবনের পর তিনি ২০১২ সালে সহকারী কমিশনার পদে পদোন্নতি পান। দুই বছর পর, ২০১৪ সালের ৬ জুলাই তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
দুদক সূত্র বলছে, অবসরের পর তার আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সম্পদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানতের বিপুল অঙ্কের অর্থ জমার বিষয়টি দুদকের নজরে আসে। এরপরই তাকে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে তদন্ত শুরু হয়।
দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি দমনে এটি একটি নজিরবহুল মামলা। চট্টগ্রাম অঞ্চলে কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এর আগেও নানা সময়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, তবে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরাসরি এমন মামলা তুলনামূলকভাবে বিরল।
একজন জ্যেষ্ঠ দুদক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা যদি সম্পদের প্রকৃত তথ্য গোপন করেন বা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেন, তা অবসরোত্তর জীবনেও তাকে আইনি দায় থেকে মুক্তি দেয় না। দুদক এই ধরনের মামলায় শূন্য সহনশীলতা নীতি অনুসরণ করছে।”
অন্যদিকে, কাস্টমস বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আহসান হাবিবের বিরুদ্ধে এই মামলাটি পুরো বিভাগের জন্য একটি সতর্কবার্তা। তারা বলেন, “যারা সরকারি দায়িত্বে থেকে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেন, তাদের শাস্তি অবধারিত।”
দুদকের এ মামলার মাধ্যমে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কাঠামোয় দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নতুন অধ্যায় যুক্ত হলো। এখন মামলার তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হলে, তা বিচারিক প্রক্রিয়ায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা যাচাইয়ে দুদকের এই পদক্ষেপকে অনেকে দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগের ধারাবাহিক সাফল্য হিসেবেও দেখছেন।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



