ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ভোট আয়োজনের লক্ষ্যে কমিশন দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে। এর অংশ হিসেবে ৬৬টি দেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন পেয়েছে, যারা মাঠপর্যায়ে ভোটের আগে ও ভোটের দিন পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) রাতে এ সংক্রান্ত এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে নির্বাচন কমিশন। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রাথমিক যাচাই–বাছাই ও আইনগত যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়ে এ ৬৬টি সংস্থাকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সংস্থাগুলো এখন ভোটকেন্দ্র, প্রচারণা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ভোটার উপস্থিতি, ব্যালট গণনা এবং সামগ্রিক নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।
এর আগে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় ৯৬টি দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধিত ছিল। তবে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৩ সালের পুরোনো নীতিমালা বাতিল করে “নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা ২০২৫” প্রণয়ন করে। নতুন নীতিমালায় পর্যবেক্ষকদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং মাঠপর্যায়ে সক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু নতুন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় পুরোনো ৯৬টি সংস্থার নিবন্ধন বাতিল করে কমিশন চলতি বছরের আগস্টে নতুন করে আবেদন আহ্বান করে। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর ৭৩টি স্থানীয় সংস্থার প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করে গণবিজ্ঞপ্তি দেয় ইসি। ওই তালিকা নিয়ে উত্থাপিত আপত্তি ও যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্তভাবে ৬৬টি সংস্থাকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ইসি সচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আমরা চাই নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ হোক। এজন্য পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেন নিরপেক্ষভাবে মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারেন, সেই পরিবেশ তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য।”
নিবন্ধন পাওয়া সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ে সামাজিক উন্নয়ন, মানবাধিকার, নারী ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করা বহু সংগঠন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্থাগুলো হলো—
পাথওয়ে, পল্লীশ্রী, রিসডা-বাংলাদেশ, আরএইচডিও, আইসিডিএস, বাকেরগঞ্জ ফোরাম, সাথী, বকুলতলী মহিলা সংসদ, অ্যাসোসিয়েশন অব মুসলিম ওয়েলফেয়ার এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশ, হোপ, আরপিও ফাউন্ডেশন, উষা, এসডিআরএস, এইচআরএসএস, এডাব, লাইট হাউজ, রূপান্তর, গণউন্নয়ন কেন্দ্র (জিইউকে), অন্তরঙ্গ সমাজকল্যাণ সংস্থা, মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা, আশ্রয় ফাউন্ডেশন, গরীব উন্নয়ন সংস্থা, সচেতন নাগরিক সোসাইটি, নজরুল স্মৃতি সংসদ, ব্রতী সমাজকল্যাণ সংস্থা, দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থা ইত্যাদি।
এছাড়া আরও রয়েছে—জয়পুরহাট হিউম্যান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, সমাজ উন্নয়ন পরিষদ, বীণা ফাউন্ডেশন, উত্তরণ, স্বাধীনতা সমাজকল্যাণ কেন্দ্র, এনজিও ফোরাম ফর সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার, বাংলাদেশ ইয়ুথ রিফর্ম সোসাইটি, আরবান হেলথ ডেভেলপমেন্ট ফোরাম, হেল্প হিউম্যানিটি অর্গানাইজেশন, সেভ বাংলাদেশ, টিম ফর টুমরো, প্রগতি উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষা পরিষদ, মানবিক বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য আঞ্চলিক পর্যবেক্ষক সংগঠন।
এসব সংস্থা দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে আছে এবং প্রায় সবগুলোই স্থানীয় পর্যায়ে নিবন্ধিত বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন (এনজিও)। তারা জেলা প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন নিয়ে ভোটের আগে পরিবেশ পর্যবেক্ষণ, প্রচারণার মান, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা, প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা, ভোটগ্রহণের স্বচ্ছতা ও ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী,
-
পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর কার্যক্রম হতে হবে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নিরপেক্ষ।
-
পর্যবেক্ষকদের মাঠে নামার আগে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও কোড অব কন্ডাক্টে স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক।
-
সংস্থাগুলোকে নিজস্ব অর্থায়নে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, কোনো প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করা যাবে না।
-
পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট নিরপেক্ষভাবে লিখিত আকারে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে হবে।
-
পর্যবেক্ষকরা চাইলে ভোটের দিন সরাসরি ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থেকে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
ইসির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, “আমরা চাই পর্যবেক্ষকরা যেন শুধু ভোটের দিন নয়, পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিই মূল্যায়ন করেন—তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রচারণা, ভোটগ্রহণ ও ফল ঘোষণার সময় পর্যন্ত। এটাই হবে প্রকৃত অর্থে স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ।”
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ। দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষকরা মাঠপর্যায়ে উপস্থিত থাকলে তা ভোটারদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং নির্বাচনকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, “বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা শুধু ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকেন না, বরং ভোটের আগের রাজনৈতিক পরিবেশ, প্রার্থীদের আচরণ এবং প্রশাসনিক ভূমিকা সম্পর্কেও মূল্যায়ন দেন। এই তথ্য ভবিষ্যতের নির্বাচনী সংস্কার ও আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”
তবে তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, “যে কোনো পর্যবেক্ষণ নিরপেক্ষ না হলে তার কোনো মূল্য থাকে না। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা পর্যবেক্ষকদের সততা ও পেশাদারিত্বের ওপর নির্ভর করে।”
দেশি সংস্থার পাশাপাশি বিদেশি পর্যবেক্ষক দলগুলোকেও নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় রেখেছে ইসি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, ওআইসি, সার্ক পর্যবেক্ষক ফোরামসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতিমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইসি জানিয়েছে, বিদেশি সংস্থাগুলোর নিবন্ধন চূড়ান্ত করা হবে এই মাসের শেষ সপ্তাহে।
নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী হাবিবুল আউয়াল এক সাম্প্রতিক সভায় বলেন, “নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনই আমাদের মূল লক্ষ্য। পর্যবেক্ষকরা যদি তাদের দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন, তবে নির্বাচন নিয়ে অযথা বিতর্কের অবসান ঘটবে। আমরা চাই—জনগণ ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাক, এবং তারা যেন নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারেন।”
বাংলাদেশে নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার প্রতীক। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে যখন রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তখন নির্বাচন কমিশনের এই ৬৬ সংস্থার নিবন্ধন শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য ভোট আয়োজনের দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এখন নজর থাকবে—এই পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো মাঠপর্যায়ে কতটা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে এবং তাদের প্রতিবেদন কতটা বাস্তবচিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



