
ছবি: সংগৃহীত
গাজা শহরে নতুন করে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে ইসরায়েলের আগ্রাসন। দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র স্থল অভিযান শুরু করেছে দখলদার বাহিনী। শহরের আকাশ থেকে যেন বৃষ্টির মতোই বোমা পড়ছে, রাস্তায় ট্যাঙ্ক, ড্রোন আর রোবট একযোগে হামলা চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি মরিয়া হয়ে শহর ছাড়ছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছেন যে গাজার ওপর চালানো এই অভিযান মানবতার জন্য অশনিসংকেত।
মঙ্গলবার দিনভর গাজা শহরে চলেছে ইসরায়েলের নির্দয় গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা। আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, অন্তত ৯১ জন ফিলিস্তিনি সেদিন একদিনেই প্রাণ হারান। সবচেয়ে মর্মান্তিক ছিল দক্ষিণমুখী ফিলিস্তিনিদের বহনকারী গাড়িবহরে চালানো বোমা হামলা। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যারা গাজার কেন্দ্র ও পশ্চিমাঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তারাও রেহাই পাননি। এ ছাড়া একের পর এক আবাসিক ভবন ধ্বংস করে দিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। পুরো শহর এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ইসরায়েলের হামলায় এবার নতুন সংযোজন বোমা বহনকারী রোবট। মানবাধিকার সংস্থা ইউরো-মেড মনিটরের তথ্যমতে, অন্তত ১৫টি রোবট মোতায়েন করা হয়েছে, যেগুলো একসঙ্গে ২০টি বাড়ি ধ্বংস করতে সক্ষম। এগুলো উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব গাজায় কার্যত মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর ও অবকাঠামো। প্রযুক্তির এই নির্মম ব্যবহারকে অনেকেই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।
দুই বছরের যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষ ধ্বংসস্তূপের মাঝেই গাজা শহরে ফিরে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। কিন্তু নতুন করে হামলা জোরদার হওয়ায় আবারও শহর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন বাসিন্দারা। ইসরায়েলের এক সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অন্তত সাড়ে ৩ লাখ মানুষ গাজা শহর ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি—শুধু কেন্দ্র ও পশ্চিমাঞ্চল থেকেই সাড়ে ৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যাদের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার পুরোপুরি শহর ছেড়ে চলে গেছেন। ফলে শহরের প্রকৃত জনসংখ্যা কতটা আছে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন—“গাজা জ্বলছে।” তার এই মন্তব্য ইসরায়েলের আগ্রাসী কৌশল ও ‘ভূমি খালি করার’ পরিকল্পনারই বহিঃপ্রকাশ। আন্তর্জাতিক মহলে তার এই উক্তিকে এক ধরনের স্বীকারোক্তি হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ আসলে এক ধরনের গণহত্যা। কমিশনের মতে, ইসরায়েলের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে যে ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন, তা থেকে স্পষ্ট হয়—জাতি হিসেবে ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, প্রায় দুই বছরের যুদ্ধ এবং প্রায় ৬৫ হাজার মানুষের প্রাণহানি ফিলিস্তিনের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত তৈরি করেছে।
গাজার হাসপাতালগুলো এখন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, এমনকি পানির সরবরাহও সংকটাপন্ন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গাদাগাদি করে ঠাঁই নিয়েছেন বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো। শিশু ও নারীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় মানবিক সংকট দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সাহায্য সংস্থাগুলো জানিয়েছে, খাদ্য, পানি, চিকিৎসা এবং আশ্রয়ের অভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষেরা মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসের পাশাপাশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও ইসরায়েলের অভিযানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তবে বড় শক্তিগুলোর দ্বিধান্বিত অবস্থানের কারণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনও দেখা যায়নি। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সনদকে উপেক্ষা করেই ইসরায়েল গাজায় পরিকল্পিতভাবে জাতিগত নিধন চালাচ্ছে।
দুই বছরের অব্যাহত যুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের জীবনে অকল্পনীয় দুর্দশা বয়ে এনেছে। একদিকে হাজারো মৃত্যু, অন্যদিকে লাখ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতি—সব মিলিয়ে গাজার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায় যেন লেখা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল নিন্দা করলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে গণহত্যার অভিযোগ ওঠার পর এখন বিশ্ব রাজনীতির বড় প্রশ্ন—এবার কি সত্যিই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো আন্তর্জাতিক জবাবদিহি গড়ে উঠবে, নাকি ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা শুধু রিপোর্টের কাগজেই আটকে থাকবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ