
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। দেশের আমদানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ আর রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশই হয়ে থাকে এই বন্দর দিয়ে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় মাশুল বাড়ানো মানেই ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব। সম্প্রতি বন্দর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে ৫৬টি সেবায় গড়ে প্রায় ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধি করার ফলে নতুন করে আলোচনায় এসেছে আমদানিনির্ভর অর্থনীতি। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের বাজারে এ সিদ্ধান্তের প্রভাব সরাসরি পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
গত রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান সই করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন মাশুল বৃদ্ধির গেজেট প্রকাশ করা হয়। ঘোষিত গেজেট অনুযায়ী সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে কার্যকর হয়েছে নতুন ট্যারিফ কাঠামো।
নতুন গেজেটে কনটেইনার, পাইলটিং, গ্যান্ট্রি ক্রেন চার্জসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে মাশুল বাড়ানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি টিইইউস (২০ ফুট একক) কনটেইনারে গড়ে মাশুল এখন দিতে হবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা, যা আগে ছিল ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। কনটেইনার ওঠানো-নামানোতে চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৮ ডলার, আগে ছিল মাত্র ৪৩.৪০ ডলার। আর জাহাজের পাইলটিং চার্জ পূর্বের ৩৫৭ ডলার থেকে এক লাফে বেড়ে হয়েছে ৮০০ ডলার।
এছাড়া গ্যান্ট্রি ক্রেন চার্জ ধরা হয়েছে ২০.৮০ ডলার, যা আগে ছিল ১৫ ডলার। প্রচলিত কার্গোর রিভার ডিউজ, ওয়্যারফেজ চার্জ, স্টোরেজ চার্জ—সব ক্ষেত্রেই বৃদ্ধি করা হয়েছে।
আমদানিকারকরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত সরাসরি ভোগ্যপণ্যের দামে প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে গম, ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ফলমূল, রসুন, আদা, মাছ-মাংসের মতো খাদ্যপণ্য আমদানির খরচ বাড়বে। দেশের বেকারিশিল্প এবং খাদ্যপ্রসেসিং কারখানায় গমের ব্যবহার ব্যাপক। অথচ দেশের চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর।
খাতুনগঞ্জের গম ব্যবসায়ী ও মুনাল ট্রেডিংয়ের অংশীদার সুমন বাবু বলেন, “আমাদের দেশে বেকারির পণ্য ও খাদ্যশিল্পে গমের ব্যবহার অত্যন্ত বেশি। মাশুল বৃদ্ধির কারণে এখন গম আমদানির খরচ বেড়ে যাবে। এর প্রভাব ভোক্তাপর্যায়ে পড়বেই।”
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ তৌহিদুল আলম বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে ফলের দাম আগেই বাড়তি। নতুন মাশুল বৃদ্ধির কারণে আমদানি করা ফলের দাম আরও বাড়বে। বিশেষ করে রেফার কনটেইনারে আসা ফল, মাছ-মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
শিপিং এজেন্ট ও শিল্প মালিকরা বলছেন, বাড়তি ট্যারিফ কেবল খাদ্যপণ্যে নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল কবীর সুজন বলেন, “আমরা বলেছিলাম, মাশুল বাড়াতে হলে সর্বোচ্চ ১০-১৫ শতাংশ বাড়ানো উচিত। কিন্তু এখন সব সেবায় গড়ে ৪১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। এর ফলে আমদানি খরচ বাড়বে এবং ব্যবসায়ীরা সেই খরচ ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করবে। শেষমেশ ভোক্তাই চাপে পড়বে।”
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, “আমদানি-রপ্তানির খরচ বাড়লে কাঁচামালের দাম বাড়বে, উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে পণ্যের দাম যেমন ভোক্তার ওপর গিয়ে চাপ সৃষ্টি করবে, তেমনি রপ্তানি বাজারেও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।”
সিকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুল হক বিষয়টিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, “মাশুল ৩৯ বছর পর বাড়ানো হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ডলারের বিপরীতে টাকার মান বিবেচনায় মাশুল চারগুণ বেড়েছে অনেক আগেই। এখন আবার নতুন করে বাড়ানো হলো। অথচ বন্দর কখনো লোকসানে ছিল না। দুর্নীতি ঠেকাতে পারলে রাজস্ব আয় বাড়ত, মাশুল বাড়ানোর দরকার হতো না।”
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ ভিন্ন মত পোষণ করছে। তাঁদের মতে, খরচ বৃদ্ধির প্রভাব ভোক্তাপর্যায়ে খুব একটা পড়বে না।
বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, “আমাদের হিসাব অনুযায়ী, বাল্কপণ্যে বিদ্যমান রেটে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ত ৩২ পয়সা। নতুন ট্যারিফে তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৪৪ পয়সা। অর্থাৎ কেজিপ্রতি মাত্র ১২ পয়সা বাড়ছে। এত সামান্য বৃদ্ধির কারণে ভোক্তার ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।”
মাশুল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই শিপিং এজেন্টগুলোও নতুন চার্জ চাপিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আমদানিকারকরা। রেফার কনটেইনারে ইলেকট্রিক মনিটরিং চার্জ যেখানে আগে কম ছিল, এখন প্রতিটি কনটেইনারে দৈনিক ৪০ ডলার করে বাড়ানো হয়েছে। গোল্ড স্টার শিপিং লাইন ও এভারগ্রিন শিপিং ইতিমধ্যেই নতুন চার্জ ঘোষণা করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, মাশুল বৃদ্ধির ফলে একদিকে আমদানির ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হবে। আমদানি নির্ভর শিল্পগুলো যেমন সিমেন্ট, ভোজ্যতেল, শিপইয়ার্ড, অ্যাগ্রো-প্রসেসিং এবং খুচরা বাজারে সরাসরি প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ অর্থনীতির একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি। নতুন এই মাশুল বৃদ্ধির ফলে খাদ্যপণ্যের দামের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে, যা ভোক্তা সাধারণের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
সব মিলিয়ে, চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে ঘিরে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করছে প্রভাব সামান্য হবে, কিন্তু ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা বলছেন বিপরীত কথা। শেষ পর্যন্ত এই বাড়তি মাশুল ভোক্তার ঝুলিই কতটা ভারী করবে—তা সময়ই বলে দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ