
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মঙ্গলবার (১৫ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত এক পরিদর্শন ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের নাগরিকদের কাছে শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন। আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে তিনি মন্দিরে উপস্থিত হয়ে দুর্গাপূজার প্রাক্কালে দেশের শান্তি, ঐক্য ও নাগরিক অধিকার বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনা ও আহ্বান জানিয়েছেন।
“এবার মনটা শান্ত হলো যে দুর্গাপূজা উপলক্ষে আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো। আপনারা সাক্ষ্য দেবেন যে আমি হাজির ছিলাম। এখন শান্ত মনে আমি জাতিসংঘের দিকে রওনা হতে পারবো। সবাই দোয়া করবেন, আশীর্বাদ করবেন, নমস্কার।” এই কথাগুলো দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি জানান, চলতি মাসের শেষে শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হলে তিনি জাতিসংঘের নিউইয়র্ক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। তাই আগাম শুভেচ্ছা জানাতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হাজির হন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “নিজেদের মধ্যে বিভাজন থাকলে, ঐক্যবদ্ধ না হলে আমরা জাতি হিসেবে ব্যর্থ হয়ে যাব। আমরা জাতি হিসেবে ব্যর্থ হতে চাই না। আমাদের তরুণরা জেগেছে। আমাদের মানুষ জেগেছে। আমরা নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি, সেটা নিশ্চিত করতে চাই। তা না হলে এত রক্তপাত, এত আত্মত্যাগের কী ফল পেলাম?”
তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইতে আমাদের তরুণরা যে অসাধ্য সাধন করেছে, তার মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। এই দেশে সব নাগরিক সমান সুযোগ পাবে, জন্ম যেখানেই হোক, ছেলে হোক বা মেয়ে হোক—সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। “পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার শক্তি তাদের আছে। তারা কেউ বন্দী হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। কারও ভয়ে পালিয়ে থাকার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। আমরা তাদের সেই সুযোগ দিতে চাই। তারা নিজের মতো করে গড়ে উঠবে। দেশকে গড়ে তুলবে। পৃথিবীতে গড়ে তুলবে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা এমন রাষ্ট্র গঠন করতে চাই, পৃথিবী আমাদের অনুসরণ করবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার অগ্রযাত্রা শুরু করেছি। তার সফল বাস্তবায়ন করতে হলে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা মতের ভেদ ভুলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সব অশুভ, অন্যায় ও অন্ধকার শক্তিকে পরাজিত করতে হবে। ঐক্য ও সম্প্রীতির জয় হবে। কল্যাণ ও সম্প্রীতির পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।”
একটি রাষ্ট্রকে পরিবার হিসেবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “পরিবারে নানা মতভেদ থাকবে, ব্যবহারের পার্থক্য থাকবে। তবে পরিবার অটুট। এটাকে কেউ ভাঙতে পারবে না। আমাদের লক্ষ্য হলো, আমরা জাতি হিসেবে অটুট একটি পরিবার হিসেবে দাঁড়াতে পারি। যত ধর্মীয়, সামাজিক বা মতের পার্থক্যই থাকুক, রাষ্ট্র আমাদের সমান মর্যাদা দেবে। অসীম ধনের অধিকারী হোক বা নিঃস্ব হোক, রাষ্ট্রের কাছে সে একজন নাগরিক। নাগরিকের সব অধিকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ। তাকে ক্ষুদ্র পরিমাণেও বঞ্চিত করার কোনো অধিকার সরকারের নেই।”
তিনি নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানান, “আমরা মাঝে-মাঝে পারিবারিক বা অন্যান্য বিষয়ে সোচ্চার হয়ে যাই, তবে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হতে হবে। কারণ রাষ্ট্র আমাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করেছে। এটাতে কোনো বিকল্প নেই।”
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনীর মধ্যে ধর্ম পালন করতে চাই না। আমরা নাগরিক হিসেবে মুক্তভাবে যার যার ধর্ম পালন করতে চাই। এই অধিকার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের ভূমিকা পালন করার জন্য ধন্যবাদ। তবে আমরা এমন দেশ চাই, যেখানে ধর্ম পালন করতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনী থাকবে না। এত রক্তপাতের পর আমরা এমন পরিস্থিতি চাই না।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ঐক্যের কথা দুর্গাপূজার কাঠামোর মধ্যেই আছে। সনাতনী ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী দুর্গাপূজার মাধ্যমে দেশ ও জাতির ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তা পাওয়া যায়। লক্ষ্মীর ধন, সরস্বতীর জ্ঞান, কার্তিকের বীরত্ব, গণেশের সাফল্য এবং দশভোজা দুর্গার শক্তি সম্মিলিতভাবে সব অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে। যার যার শক্তি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হলে আমরা সব প্রতিবন্ধকতা পার করতে পারব।”
অধ্যাপক ইউনূস সমগ্র জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, নাগরিক হিসেবে সব অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সোচ্চার হতে হবে। তিনি বলেন, “আমাদের বারবার লাঞ্ছিত হওয়া, অপমানিত হওয়া এবং বৈষম্যের শিকার হওয়া এড়ানো সম্ভব, যদি আমরা নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সচেতন হই। আমরা যেই নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এই বক্তব্য একদিকে ধর্মীয় উৎসবের আনন্দ এবং ঐক্যের বার্তা বহন করে, অন্যদিকে দেশের নাগরিকদের অধিকার, সমান সুযোগ এবং বৈষম্যবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার গুরুত্বকে শক্তভাবে তুলে ধরে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ