
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বর্তমানে গভীর অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও রাজনৈতিক সমঝোতার অভাব, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিন্নমুখী অবস্থানের কারণে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক সংশয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ় অবস্থান
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি একাধিক বক্তব্যে পরিষ্কার করেছেন যে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। তিনি ১১ সেপ্টেম্বর এক আলোচনায় বলেন, “ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই।” একই সুরে ৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবও জানান, নির্বাচনের সময়সীমা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই এবং পৃথিবীর কোনো শক্তিই এ নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজও সতর্ক করেছেন যে, ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত সময়সীমায় নির্বাচন না হলে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে, জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে এবং অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হতে পারে। অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা বারবার নির্বাচিত সরকারের হাতে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানাচ্ছেন।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জট
বর্তমানে সংকটের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন। জুলাই সনদে প্রস্তাবিত কিছু সংস্কার নির্বাহী আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের মতবিরোধ।
জামায়াতে ইসলামী, ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল পার্টি (এনসিপি)সহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে সনদ পুরোপুরি বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। জামায়াত এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আদেশ জারির প্রস্তাব দিয়েছে, আর এনসিপি প্রস্তাব করেছে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন। অন্যদিকে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল মনে করছে, নির্বাচনের আগে এত বড় সাংবিধানিক সংস্কার করা সম্ভব নয়; এ দায়িত্ব নির্বাচিত সংসদের ওপরই বর্তাবে।
জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার দাবিও উঠেছে, যা রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক (PR) পদ্ধতি চালুর বিষয়টিও বিরোধের জন্ম দিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এটিকে রাজনৈতিক কৌশল বলে অভিহিত করে বলেন, জনগণের নামে কোনো দলের আদর্শ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সঠিক নয়।
রাজনৈতিক কর্মসূচি ও বিভক্তি
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে জামায়াতে ইসলামীসহ চারটি ইসলামী দল আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। শিগগিরই আরও কয়েকটি দল এই কর্মসূচিতে যুক্ত হতে পারে। তবে বিসিএস পরীক্ষার বিষয় বিবেচনায় এনে জামায়াত তাদের বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারের কর্মসূচির সময়সূচি কিছুটা পরিবর্তন করেছে।
অন্যদিকে বিএনপি, তাদের মিত্র দল ও বামপন্থি দলগুলো এই কর্মসূচির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিএনপির মতে, আলোচনার মধ্যেই আন্দোলন শুরু করা স্ববিরোধিতা।
ঐকমত্য কমিশনের সীমাবদ্ধতা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাগুলোতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে কোনো সমঝোতা গড়ে ওঠেনি। কমিশন প্রথমে ছয় মাসের জন্য গঠিত হলেও মেয়াদ এখন একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমিশনের কার্যক্রম আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে। সদস্যরা দলগুলোর সঙ্গে একাধিক দফা বৈঠক করলেও এখনও কোনো চূড়ান্ত সমাধান পাওয়া যায়নি।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ স্পষ্ট করেছেন যে, এই আলোচনা অনন্তকাল চলতে পারে না। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে, তাই দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে তারা জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে “নতুন বাংলাদেশ” গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করে।
বিভিন্ন দলের অবস্থান
বিএনপি জানিয়েছে, তারা সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত, তবে সেখানে ভিন্নমত (Note of Dissent) সংযুক্ত থাকবে। তাদের মতে, নির্বাচনের পর যেই দল ক্ষমতায় আসবে, তারা নিজেদের অবস্থান অনুযায়ী সেসব ভিন্নমত বাস্তবায়ন করবে।
জামায়াত মনে করছে, নির্বাচনের আগেই সনদ বাস্তবায়ন জরুরি, তা না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রয়োজনে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামত নেওয়ার কথাও বলেছে দলটি। এনসিপি গণপরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি তুলেছে।
বিশেষজ্ঞ মত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্দেশ্য ছিল জরুরি প্রয়োজনে একটি সীমিত সময়ের জন্য ক্ষমতা পরিচালনা করা। কিন্তু প্রায় এক বছর পার হয়ে গেলেও নির্বাচন আয়োজন করা হয়নি। তিনি বলেন, নেপালে অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে, অথচ বাংলাদেশে তা হয়নি।
তার মতে, সংস্কার নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে পারে। সব দলের সব দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়, তাই যেসব সংস্কারে ন্যূনতম ঐকমত্য আছে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
সম্ভাব্য ঝুঁকি
যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হয়, তবে শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটই নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবে, অর্থনীতি আরও অস্থির হয়ে পড়বে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্থিতিশীলতার একমাত্র পথ হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। জনগণও দীর্ঘদিন ধরে সেই নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। এখন প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছতে পারবে কি না।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ওপর। এই নির্বাচন হবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত—কিন্তু সবার চোখ এখন ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার দিকে, যেখানেই হয়তো আগামী দিনের রাজনৈতিক বাস্তবতার চূড়ান্ত রূপরেখা নির্ধারিত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ