
ছবি: সংগৃহীত
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা এক্স—যেখানেই চোখ রাখুন, লাল কিংবা সাদা শাড়ি পরা নারীর ছবি ভেসে উঠছে। কপালে টিপ, খোঁপায় ফুল, কখনো আবার রেট্রো ধাঁচের লুকে সাজানো। এর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের থ্রি-ডি মূর্তি এবং পাশাপাশি ক্যানভাসে আঁকা তাদের প্রতিকৃতি। নতুন এ ট্রেন্ড এখন নেট দুনিয়া কাঁপাচ্ছে।
বর্তমানে দুটি ট্রেন্ড বিশেষভাবে ভাইরাল হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে গুগল জেমিনির তৈরি ‘ন্যানো ব্যানানা এআই শাড়ি’। দ্বিতীয়টি হলো ‘ন্যানো ব্যানানা থ্রি-ডি ফিগারিন’। ভারত থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন এই ট্রেন্ডে মেতেছে সবাই। কয়েক মাস আগেই নেট দুনিয়ায় আলোচনায় এসেছিল ‘ঘিবলি আর্ট’—যা জাপানি অ্যানিমেশন স্টুডিও স্টুডিও ঘিবলি থেকে অনুপ্রাণিত। তবে এবারকার এআই শাড়ি ট্রেন্ড তার চেয়ে বহুগুণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এআই জেনারেটেড ছবিগুলো তৈরির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে গুগল জেমিনির ন্যানো ব্যানানা মডেল। এটি একটি ইমেজ জেনারেটর টুল, যা ব্যবহারকারীর দেওয়া নির্দেশনা বা ‘প্রম্প্ট’ অনুযায়ী ছবি তৈরি করে। প্রম্প্টে উল্লেখ করতে হয় শাড়ির রঙ, ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন হবে, আলো কীভাবে পড়বে, এমনকি চুল বাঁধার ধরনও। ব্যবহারকারী নিজের ছবি আপলোড করলে টুলটি সেই প্রম্প্ট মেনে একেবারে নতুন রূপে ছবিটি তৈরি করে দেয়।
থ্রি-ডি ফিগারিন ট্রেন্ডের ক্ষেত্রে তৈরি হয় ব্যবহারকারীর ছোট একটি মূর্তি এবং তার পাশেই আঁকা একটি স্কেচ।
সামাজিক মাধ্যম বিশেষজ্ঞ সিমরন পি কৌর জানিয়েছেন, “ভারতে গত কয়েক দিনে লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারী এই ট্রেন্ডে অংশ নিয়েছেন। সেলেব্রিটি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই এখন এআই শাড়ি বা থ্রি-ডি ফিগারিন ছবিতে মেতে উঠেছেন। কীভাবে সঠিক প্রম্প্ট ব্যবহার করতে হয় সেটি নিয়েও অনেকে আলোচনা করছেন।”
প্রযুক্তিবিদ সৌম্যক সেনগুপ্ত বলেন, “বিভিন্ন এআই মডেল ভিন্ন কাজের জন্য প্রশিক্ষিত। ন্যানো ব্যানানা মডেল মূলত ইমেজ জেনারেট করার জন্য বানানো। ব্যবহারকারীরা যত নিখুঁত নির্দেশনা দেবেন, ছবিও তত নিখুঁতভাবে তৈরি হবে। এআই শাড়ি এবং থ্রি-ডি ফিগারিন এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি ট্রেন্ড।”
আসামের তরুণী নেহা সিং জানালেন, “ইনস্টাগ্রামে বন্ধুদের ছবি দেখে আমারও ইচ্ছে হলো। প্রথমে ভেবেছিলাম সহজ হবে, কিন্তু পারফেক্ট প্রম্প্ট ব্যবহার করে মনমতো ছবি পেতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করতে হয়েছে। ৯০ দশকের বলিউড নায়িকাদের মতো ছবি পেতে চুল বাঁধা, আলো কেমন হবে—এসব আলাদা করে নির্দেশ দিতে হয়েছে।”
শিক্ষার্থী অম্স্মিতা চক্রবর্তী বলেন, “আমি সব ট্রেন্ড ফলো করি। ঘিবলি আর্ট করেছিলাম, এবার এআই শাড়িও করেছি। বন্ধুরা সবাই করছে, বাদ পড়তে চাইনি।”
শিক্ষিকা সাগরিকা দাস জানান, প্রথমে তার মেয়ে ছবি এডিট করে দিয়েছিল। পরে কৌতূহল থেকে নিজেই চেষ্টা করেছেন।
সাংবাদিক এ অরবিন্দ বলছেন, “এই ট্রেন্ড প্রধানত বলিউড থেকে অনুপ্রাণিত। ইনস্টাগ্রামে যেসব ছবি ভাইরাল হচ্ছে, তার বেশিরভাগই রেট্রো বলিউড অভিনেত্রীদের স্টাইলের সঙ্গে মিলে যায়। সোনাক্ষী সিনহা থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারতের তারকারাও এই ট্রেন্ডে অংশ নিয়েছেন। এমনকি প্রবীণ অভিনেতা রাকেশ রোশনও থ্রি-ডি ফিগারিন ছবি শেয়ার করেছেন।”
বিশ্লেষকদের মতে, সেলেব্রিটিরা যখন কোনো ট্রেন্ড ফলো করেন, তখন তা দ্রুত সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
টলিউড অভিনেত্রী রূপসা মুখোপাধ্যায় অবশ্য এই ট্রেন্ডে সায় দিচ্ছেন না। তার মতে, “এআই ইমেজ বাস্তব চেহারার সঙ্গে পুরো মেলে না। আমার ফ্যানরা এডিট করা ছবি পাঠিয়েছেন বলে শেয়ার করেছি। কিন্তু নিজে এই ট্রেন্ড অনুসরণ করতে চাই না। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার স্বাদই আলাদা।”
একইসঙ্গে কিছু ফটোগ্রাফারও মনে করছেন, এআই কোনোদিনই আসল ফটোগ্রাফির জায়গা নিতে পারবে না। ফটোগ্রাফার উজ্জ্বল রায় বলেন, “আলো, ফোকাস, মুহূর্ত—এসব সামঞ্জস্য করার যে আনন্দ, সেটা এআই দিতে পারবে না।”
সিমরন পি কৌরের মতে, “শাড়ি ফ্যাশনের দিক থেকে চিরকাল জনপ্রিয়। আবার বলিউডের অনুপ্রেরণাও আছে। ফলে এই ট্রেন্ড দ্রুত ভাইরাল হয়েছে। থ্রি-ডি ফিগারিন আলাদা আকর্ষণ তৈরি করেছে।” তবে তিনি মনে করেন, “এটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কয়েকদিন পরই মানুষ নতুন কোনো ট্রেন্ডের দিকে ঝুঁকবে।”
এআই ছবি বাস্তব চেহারার সঙ্গে হুবহু না মেলার বিষয়টি অনেকে উল্লেখ করেছেন। সৌম্যক সেনগুপ্ত ব্যাখ্যা করে বলেন, “প্রাইভেসির জন্য কিছু সীমাবদ্ধতা রাখা হয়েছে। তাই জেনারেটেড ছবি আসল ছবির কাছাকাছি হলেও পুরোপুরি মিলবে না। এছাড়া কপিরাইট লঙ্ঘন এবং ডিপফেকের মতো অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকছেই।”
‘ন্যানো ব্যানানা এআই শাড়ি’ এবং ‘থ্রি-ডি ফিগারিন’—এই দুটি ট্রেন্ড অল্প কয়েকদিনেই ভারত ও বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের নেট দুনিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। প্রযুক্তির চমক, বলিউডের প্রভাব এবং ব্যবহারকারীদের কৌতূহল মিলেই এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক মাধ্যমের ট্রেন্ড যেমন দ্রুত ভাইরাল হয়, তেমনি দ্রুত হারিয়েও যায়। তাই এআই শাড়ির এই মাতামাতিও হয়তো আর কিছুদিন পর নতুন কোনো ট্রেন্ডের কাছে জায়গা ছেড়ে দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ