
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য খালাস প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও জালিয়াতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া রাজিব দাশ ওরফে লিটন (৫১) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নুসরাত জাহান জিনিয়ার আদালতে তিনি এই জবানবন্দি দেন। আদালত তার স্বীকারোক্তি গ্রহণ করার পর তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এর আগে রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) নগরের ডবলমুরিং থানাধীন আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রাজিব দাশকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি কাস্টমস জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন।
পিবিআই সূত্রে জানা যায়, রাজিব দাশ চট্টগ্রামের একটি সিএন্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) প্রতিষ্ঠানে বহু বছর ধরে জেটি সরকার পদে চাকরি করছিলেন। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত মালিক অরূপ কুমার সিংহের অধীনে কাজ করলেও মালিক বিদেশে যাওয়ার পর তিনি মো. ইব্রাহীম ও মো. মিজানুর রহমান নামে দুই পরিচালকের নির্দেশে কাজ করতে থাকেন। তদন্তে দেখা যায়, তিনি বিভিন্ন সময় মালিক ও পরিচালকদের নির্দেশে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পণ্য খালাসের কাজে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখতেন।
তদন্তে উঠে আসে, ২০২০ সালের ২৪ মার্চ ভারতের একটি চালান থেকে প্লাস্টিক হ্যাঙ্গার ও লেদার বেল্ট আমদানির সময় রাজিব দাশ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মামলার নথি অনুযায়ী, ওই চালানের বিপরীতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নিকট সঠিক শুল্ক প্রদানের পরিবর্তে জাল আইপি (ইমপোর্ট পারমিট) ব্যবহার করা হয়। এই জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে শুল্ক সুবিধা নিয়ে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পণ্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, রাজিব দাশ বন্দরের রিলিজ অর্ডার, জেটি চালান এবং ট্রাক চালানসহ গুরুত্বপূর্ণ নথিতে স্বাক্ষর করেন। তার এই স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাল নথি ব্যবহার করে পণ্য ছাড়ের পথ তৈরি হয়। পিবিআইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, আসামি জানতেন যে এই নথিগুলো জাল এবং এসব ব্যবহার করলে সরকারি রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবুও মালিক ও পরিচালকদের নির্দেশে তিনি সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক মর্জিনা আক্তার সাংবাদিকদের জানান, গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই রাজিব দাশ পুরো ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি আরও জানান, রাজিব দাশ নিজেই জানিয়েছেন যে মালিকের নির্দেশে পণ্যের ডেলিভারি ডকুমেন্ট নিয়মিতভাবে অপর সহযোগী আসামি জসিম উদ্দিনের কাছে পৌঁছে দিতেন। এভাবেই জসিমসহ অন্যান্য আসামিরা নথিগুলো ব্যবহার করে কাস্টমস থেকে পণ্য খালাস করতেন।
রাজিব দাশ আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন যে, তিনি মালিক ও পরিচালকদের নির্দেশে পণ্য খালাসে জাল কাগজপত্র ব্যবহার করেছেন। আদালত জবানবন্দি গ্রহণ করার পর মামলার তদন্ত ও বিচার কার্যক্রমের স্বার্থে তাকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পিবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই মামলার সঙ্গে আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা না হলেও একে একে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। কর্মকর্তাদের মতে, এই ধরনের জালিয়াতি শুধু সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি করে না, বরং আমদানি-রপ্তানি খাতে সুশাসন ব্যাহত করে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রক্রিয়ার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব ফাঁকি, নথি জালিয়াতি ও পণ্য খালাসে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে আসছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের অপরাধে পিবিআই ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। রাজিব দাশের মতো মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তি এখন তদন্তকারী সংস্থাকে বড় ধরনের সিন্ডিকেট চিহ্নিত করতে সহায়তা করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এসজে