
ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে প্রথমবারের মতো স্বাক্ষরিত কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রিয়াদে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আট দশকের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করলো। তবে ইসলামাবাদ-রিয়াদের এই ঘনিষ্ঠতা নয়াদিল্লির জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত দুশ্চিন্তা বয়ে এনেছে।
চুক্তিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে যেকোনো একটির ওপর হামলা হলে সেটিকে অপর দেশের ওপর হামলা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। অর্থাৎ, একে অপরের নিরাপত্তার জন্য উভয় দেশ সমানভাবে দায়বদ্ধ থাকবে। এই ধারা কার্যত ন্যাটো ধরনের সামরিক চুক্তির প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছে। পাশাপাশি পাকিস্তান, যেটি একমাত্র মুসলিম পরমাণু শক্তিধর দেশ, তার কৌশলগত সক্ষমতা এখন সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা নীতির অংশ হয়ে গেল।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ভ্রাতৃত্ব, ইসলামী সংহতি, কৌশলগত স্বার্থ ও বহু দশকের সহযোগিতার ভিত্তিতে এই প্রতিরক্ষা চুক্তি উভয় দেশের নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করবে। একইসঙ্গে, বহিঃশত্রুর যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এর মাধ্যমে পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্ক অনানুষ্ঠানিক আর্থিক সহায়তা ও সামরিক প্রশিক্ষণের স্তর পেরিয়ে এখন একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা জোটে রূপ নিলো।
এই চুক্তি ইসলামাবাদের জন্য বড় কূটনৈতিক সাফল্য। সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে—ঋণ, তেল সরবরাহ কিংবা বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে। এবার সেই অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তায় পরিণত হলো। কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান এতদিন আন্তর্জাতিক মঞ্চে একা থাকলেও, এখন তারা সৌদি আরবকে আনুষ্ঠানিকভাবে পাশে টানতে পারবে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের সাথে এ ধরনের জোট পাকিস্তানের জন্য আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানোর একটি হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করবে।
ভারতের জন্য এই চুক্তি উদ্বেগের কারণ। একদিকে পাকিস্তান তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী, অন্যদিকে সৌদি আরব ভারতের অন্যতম বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারত সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং সৌদি আরব ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। লক্ষ লক্ষ ভারতীয় শ্রমিক সৌদি আরবে কর্মরত এবং সেখান থেকে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ আসে। ফলে নয়াদিল্লি চাইবে না যে সৌদি আরব সরাসরি পাকিস্তানের সাথে সামরিক জোটে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিক।
ভারতীয় কূটনৈতিক মহল বলছে, এই চুক্তি পাকিস্তানকে কাশ্মীর ইস্যুতে আরও সাহসী করে তুলতে পারে। ইসলামাবাদ যেকোনো আঞ্চলিক সংঘাতে রিয়াদের সমর্থন দাবি করতে পারে। বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসঙ্গটিই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার। যদি সৌদি আরব পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ পায়, তবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে।
চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়, “আমরা পাকিস্তান-সৌদি আরব কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হওয়ার খবর দেখেছি। ভারত সরকার আগে থেকেই জানতো যে, দুই দেশের দীর্ঘদিনের সহযোগিতাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। আমরা এই চুক্তির প্রভাব আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর কী হতে পারে, তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবো। জাতীয় স্বার্থরক্ষা এবং সর্বক্ষেত্রে সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান-সৌদি আরব প্রতিরক্ষা জোট ভারত, ইরান ও ইসরায়েলের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও রাশিয়ার সাথে রিয়াদের সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। এখন পাকিস্তানের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি এই বহুমুখী কৌশলেরই প্রতিফলন।
অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে রিয়াদ ইসলামাবাদকে সামরিক সমর্থন দিলে সেটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই চুক্তি কার্যত দক্ষিণ এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ