
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চলমান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে ক্রিকেট প্রশাসন, ক্লাব-সমিতি ও ভক্তমহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সম্প্রতি এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সরাসরি অভিযোগ তুলছেন— বিসিবি নির্বাচনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। তাঁর মতামত থেকে যা বোঝা যায়: ক্রিকেটকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা না গেলে দেশের খেলার সার্বিক স্বার্থই ক্ষুণ্ণ হবে।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, “এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, বিসিবি নির্বাচনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে।” তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, ৫ আগস্ট পর পরিস্থিতি বদলে গেছে; দেশের দুই কিংবদন্তি ক্রিকেটার—সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি বিন মর্তুজা—যারা খেলোয়াড় থেকে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন ও এমপি হয়েছেন, তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ও পরিবেশ নিয়ে অনেক ভক্তের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে তাঁর বক্তব্য: খেলা কিংবা স্পোর্টস বিষয়টাকে রাজনীতির বাইরে রাখা উচিত।
আসিফ মাহমুদ আরও বলেছেন, একটি রাজনৈতিক দলের সাবেক এমপি ও সাবেক বিসিবি প্রেসিডেন্ট যদি সংবাদ সম্মেলন করে কাউকে ‘নমিনেশন’ হিসেবে ঘোষণা করেন—যেমন তামিম ইকবালকে—তাহলে সেটি জনমনে সন্দেহ উসকে দেয়। “এটা তো জাতীয় নির্বাচন নয়, এখানে তো নমিনেশন... ওনারা যেন সংবাদ সম্মেলন করে নমিনেশন দিচ্ছেন তামিম ইকবাল ভাইকে। তো এটা একটু শঙ্কার বিষয়, আমার জায়গা থেকে, পলিসির জায়গা থেকে,” তিনি বলেন। এ ধরণের কার্যক্রম ক্রিকেট প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে—উপদেষ্টার ভাষ্য।
বিসিবি নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া টালমাটাল পরিবেশ কেবল প্রশাসনিক দ্বন্দ্বেই সীমাবদ্ধ থাকছে না; এর প্রভাব পড়ছে মাঠের পারফরম্যান্সে। আসিফ উল্লেখ করেছেন, জাতীয় দলের প্রস্তুতি ও বিশ্লেষণের কাজ দীর্ঘদিন ধরে দরকার—উদাহরণস্বরূপ এশিয়া কাপের মতো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে লিটনদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ণ করার সময় ক্রিকেট কর্তাদের ব্যস্ততার কেন্দ্র হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখন তারা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কাঁদা ছোড়াছুড়ি ও প্রশাসনিক মহড়া নিয়ে ব্যস্ত—ফল এটাও যে জাতীয় ক্রিকেট ব্যবস্থার দুর্বলতার লক্ষণ।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থায় এডহক কমিটি দিয়ে কাউন্সিলর মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে विवाद উত্তপ্ত হয়েছে। বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের পাঠানো চিঠি নিয়ে তুমুল বিতর্ক, যা এখন পর্যন্ত আদালতের দ্বারও পার হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, “কোর্ট তো বিসিবি সভাপতির চিঠিকে বৈধ বলেই নির্দেশনা দিয়েছে। দুই দফা পেছানোর পরও অধিকাংশ ক্লাবের প্রেসিডেন্টরাই তো এসেছে। যারা অভিযোগ করছেন, তারাও ওই পেছানো সময়টাকে কাজে লাগিয়েছেন এবং কাউন্সিলর পাঠিয়েছেন।”
উপদেষ্টা আরও প্রশ্ন তুলেছেন—কোনো প্রশাসনিক রুটিন কাজকে ‘হস্তক্ষেপ’ বললেই কি একজন আন্ডার কমান্ড বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাদের সংযোগ বা যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবে না? তিনি মন্তব্য করেন, “এ ধরনের হাস্যকর অভিযোগ নিয়ে এসে নিজেদের হাসির পাত্রে পরিণত করা উচিত নয়। আপনার যদি মনে হয়, কোনো কিছু নিয়মতান্ত্রীকভাবে হচ্ছে না, তাহলে কোর্টে তো গেলেই পারেন, চাইলে আইসিসির কাছে যেতে পারেন—দেশে তো এখন আইনের শাসন আছে।”
বিসিবি নির্বাচনকে ঘিরে বড় স্বনামধন্য খেলোয়াড়দের রাজনৈতিক অঙ্গন গ্রহণ করার ঘটনা পুনরায় আলোচনায় এসেছে। অনেক সমর্থক ও বিশ্লেষক মনে করছেন, খেলোয়াড়দের রাজনীতিতে যাওয়ায় ক্রিকেটের নিরপেক্ষতা, প্রশাসনিক অনুশীলন ও বোর্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রমে অভ্যন্তরীণ ফলাফল দেখা দিতে পারে। সমালোচনায় একপাশে অনেকে বলছেন—এটা খেলাধুলাকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে ছুঁড়ে ফেলার প্রয়োজনীয়তা দেখায়; অন্যদিকে ভক্তরা হতাশ যে তাদের প্রিয় খেলোয়াড়েরা মাঠের বদলে নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছেন।
বিসিবি নির্বাচন ঘিরে উঠা মামলা-মামলা, বিতর্কিত চিঠিপত্র এবং ক্লাব-সমিতির ভিন্নমত বোর্ডের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমকে বিপর্যস্ত করেছে। যদি এই অশান্তি প্রশমিত না করা হয়, তাহলে তা কেবল নির্বাচনের দিন সীমাবদ্ধ থাকবেনা—জাতীয় দলের প্রস্তুতি, টুর্নামেন্ট পরিকল্পনা, আর্থিক স্বচ্ছতা ও ক্লাব স্তরের কার্যক্রমও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উপদেষ্টা তার বক্তব্যে বারবার ইঙ্গিত দিয়েছেন—খেলাকে রাজনীতির মাঠে পরিণত করা হলে দেশের ক্রীড়া পরিবেশই শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্টরা স্পষ্ট করে জানাচ্ছেন—যদি কেউ মনে করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হচ্ছে, আইনি পথ, বিসিবির অভ্যন্তরীণ আপিল ব্যবস্থা বা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড প্রয়োগকারী সংস্থা আইসিসি’র কাছে অভিযোগ নেয়ার মতো বিকল্প রয়েছে। তবে একই সঙ্গে তিনি সতর্ক করেছেন—গণরোষ, ঘেরাও বা অশান্তি ডেমোক্রেটিক স্পিরিট নয়; সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য আইনগত ও প্রক্রিয়াগত পথই গ্রহণীয়।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা কেবল একটি নির্বাচনের ইস্যু নয়—এটি দেশের ক্রীড়া প্রশাসনের স্বচ্ছতা, খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা ও ভক্তদের আস্থা পুনর্গঠনের প্রশ্নও বটে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বিসিবি-র মতো স্বাধীন ক্রীড়া প্রশাসন নিশ্চিত করতে হলে শক্তিশালী নৈতিক নীতিমালা, স্বচ্ছ ভোটার তালিকা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঠেকাতে আইনি রোধ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অভ্যস্ত রুলস গৃহীত করতে হবে। না হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের ক্রিকেট ও দেশের ক্রীড়া পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি অনিবার্য হবে—এটাই আইন, প্রশাসন ও খেলাপ্রেমিদের যৌথ উদ্বেগ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ