
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়ে নেতিবাচক পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাই মাসে পাঁচ মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ঋণপ্রবাহে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এ প্রবণতা চলমান থাকায় শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের মন্দাভাব সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে, যা শেষ পর্যন্ত জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে নামিয়ে আনে।
ঋণপ্রবাহের চিত্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ের শেষে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাত নিয়েছে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৭৬ শতাংশ। অপরদিকে সরকারি খাত নিয়েছে সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের মাত্র ২৪ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৯৪ শতাংশই আসে বেসরকারি খাত থেকে। অথচ এই খাতেই এখন ঋণের জোগান কমতে কমতে নেতিবাচক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে।
নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা
চলতি বছরের জানুয়ারি ও জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নেতিবাচক হয়েছে। জানুয়ারিতে ঋণ স্থিতি ডিসেম্বরের তুলনায় ৫ হাজার কোটি টাকা কমে যায়। প্রবৃদ্ধি হয় মাইনাস ০.৩০ শতাংশ। জুলাইয়েও একই অবস্থা দেখা দেয়। জুনের তুলনায় জুলাইয়ে ঋণপ্রবাহ কমেছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাইনাস ০.২৯ শতাংশ।
এর আগে গত বছরের জুলাইয়েও ঋণপ্রবাহ নেতিবাচক হয়েছিল। এভাবে দুই বছরে তিনবার নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির স্থবিরতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। যদিও বছরের কিছু মাসে সামান্য ঋণপ্রবৃদ্ধি হয়েছে, তবে তা ০.২০ থেকে ১.২০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মার্চ মাসে একবার ২.১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা দিলেও সেটি মূলত ব্যাংকগুলোর সুদ মূলধনের সঙ্গে যোগ করার কারণে।
অর্থনীতির ওপর প্রভাব
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ঋণপ্রবাহ কমে গেলে বিনিয়োগ সংকুচিত হয়। এর ফলে উৎপাদন কমে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না, ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, “বেসরকারি খাত হচ্ছে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এই খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া মানেই অর্থনীতির গতি কমে যাওয়া। বেকারত্ব আরও বাড়বে যদি বিনিয়োগ না বাড়ে।”
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “ব্যবসা-বাণিজ্য বর্তমানে আইসিইউতে আছে। বিনিয়োগের পরিবেশ নেই বললেই চলে। এখন শুধু টিকে থাকার চেষ্টা চলছে। ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা ও ভুল মুদ্রানীতির কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ এখন নেতিবাচক অবস্থায়।”
সংকটের কারণ
বিশ্লেষণে দেখা যায়, একাধিক কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে—
-
ব্যাংক খাতের দুর্বলতা: আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়, যার ফলে ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে।
-
অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি: গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দেশে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
-
সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি: চার বছর ধরে সংকোচনমুখী নীতি চলছে। এতে সুদের হার বেড়েছে, টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
-
ডলারের দাম বৃদ্ধি: ২০২২ সালে ঋণপ্রবাহ কিছুটা বাড়লেও তা ছিল মূলত ডলারের দাম বাড়ার কারণে। বাস্তব অর্থে বিনিয়োগ বাড়েনি।
-
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা: সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতাও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
খাতভিত্তিক পরিস্থিতি
-
কৃষি খাত: ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশের বেশি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ১০ শতাংশের বেশি। তবে গত অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক।
-
এসএমই খাত: গত দুই অর্থবছরে ঋণপ্রবাহ স্থবির, প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে।
-
শিল্প খাত: ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিতরণ হয়েছিল ৯৫ হাজার কোটি টাকা, ২০২৩-২৪ এ কমে দাঁড়ায় ৮৯ হাজার কোটি টাকা। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে সামান্য বেড়ে ৯৭ হাজার কোটি টাকা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে ঋণ আদায় হচ্ছে না।
সামগ্রিক সংকট
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই প্রবণতা চলতে থাকলে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একদিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার নিচে নেমে যাবে, অন্যদিকে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকদের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, ব্যাংক খাতের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং সুদ ও মুদ্রানীতিতে নমনীয়তা আনা ছাড়া এই সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ