
ছবি: সংগৃহীত
সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও আওয়ামী দলের প্রভাবশালী নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। চট্টগ্রামের আদালতে দেওয়া আরামিট গ্রুপের এজিএম মো. জাহাঙ্গীর আলমের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি এই কেলেঙ্কারিকে ঘিরে নতুন মোড় নিয়েছে। জাহাঙ্গীরের স্বীকারোক্তিতে উঠে এসেছে—ভুয়া ব্যবসায়ী, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান, জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেওয়া, খালি চেক বই ব্যবহার, ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ গ্রহণ এবং পরবর্তীতে নগদ উত্তোলনের মাধ্যমে অর্থ পাচারের জটিল কৌশলের বিবরণ।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকা থেকে দুদকের উপ-পরিচালক মো. মশিউর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় জাহাঙ্গীর আলমকে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আরামিট পিএলসির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তারের সময় তাঁর কাছ থেকে সাইফুজ্জামানের স্বাক্ষরিত ১১টি চেক উদ্ধার হয়, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা উত্তোলনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
পরবর্তীতে বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-২ এর আদালতে হাজির হয়ে জাহাঙ্গীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। সেখানে তিনি স্বীকার করেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী রুকমীলা জামান এবং সহযোগী আব্দুল আজিজ, উৎপল পাল ও সৈয়দ কামরুজ্জামান সিন্ডিকেট মিলে হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন।
দুদকের একটি টিম আরামিট পিএলসির কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ২ লাখ টাকা নগদ জব্দ করেছে। এর আগে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে ২৩ বস্তা ডকুমেন্ট উদ্ধার করা হয়। শুধু তাই নয়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় সাইফুজ্জামানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা এজিএম উৎপল পাল এবং আব্দুল আজিজকে। তদন্তে যত এগোনো যাচ্ছে, ততই বেরিয়ে আসছে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের চিত্র।
জাহাঙ্গীরের জবানবন্দি অনুযায়ী, আরামিট গ্রুপের কর্মচারী ও ঘনিষ্ঠজনদের নামে ক্ল্যাসিক ট্রেডিং, প্রগ্রেসিভ ট্রেডিং, রিলায়েবল ট্রেডিং, মডেল ট্রেডিং, ভিশন ট্রেডিং, ক্রিসেন্ট ট্রেডার্স, ইমিনেন্ট ট্রেডিং, রেডিয়াস ট্রেডিং, লুসেন্ট ট্রেডিং ও ইমপেরিয়াল ট্রেডিং নামের ভুয়া প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। এগুলোর জন্য ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স বানানো হয় এবং ব্যাংক হিসাব খোলা হয়।
ব্যাংক হিসাব খোলার সময় জাহাঙ্গীর ও তাঁর স্ত্রীকে আমদানিকারক হিসেবে দেখানো হয় এবং জাহাঙ্গীরকে জোর করে শত শত খালি চেক বইয়ে স্বাক্ষর করানো হয়। এসব চেক পরে আব্দুল আজিজ নিজের কাছে রেখে ব্যবহার করতেন।
ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংক, ইউসিবি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। শুধু ক্ল্যাসিক ট্রেডিংয়ের নামে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৬৫১ কোটি ১৮ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এই টাকা ধাপে ধাপে সাইফুজ্জামান ও তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে নগদে উত্তোলন করে বিদেশে পাচার করা হয়।
এ কাজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন আরামিট পিএলসির সিওও সৈয়দ কামরুজ্জামান, এজিএম আব্দুল আজিজ ও উৎপল পাল। নগদ উত্তোলনের কাজে ব্যবহার করা হতো প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মচারী যেমন—পিয়ন ইয়াসিনুর রহমান কিংবা অফিসার হোসাইন চৌধুরী।
আরও ভয়াবহ তথ্য এসেছে ইসলামী ব্যাংকের লোন প্রক্রিয়া নিয়ে। সাইফুজ্জামানের স্ত্রী রুকমীলা জামানের নামে ইসলামী ব্যাংক জুবলী রোড শাখা থেকে ৫০০ কোটি টাকার একটি বিশাল ঋণ নেওয়া হয়। সেই টাকা ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হিসাব হয়ে প্রবাহিত হয়ে যায় ক্ল্যাসিক ট্রেডিংসহ নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে। সেখান থেকে আবারও খালি চেকের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা নগদে তুলে নেওয়া হয়।
জবানবন্দিতে জাহাঙ্গীর বর্ণনা করেছেন কিভাবে এসব টাকা বিদেশে পাচার হতো। প্রথমে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন করা হতো, পরে সেই টাকা চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করে ‘কোম্পানির বাহক’দের হাতে দেওয়া হতো। এরপর বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে নগদ টাকা বিদেশে পাঠানো হতো। এই পুরো প্রক্রিয়া পরিচালনা করতেন আব্দুল আজিজ, উৎপল পাল ও সৈয়দ কামরুজ্জামান। পাচারকৃত অর্থ দিয়ে সাইফুজ্জামান বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন, যা তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাই দেখাশোনা করতেন।
ইতোমধ্যেই দুদক এ ঘটনায় ৬টি মামলা দায়ের করেছে, যেখানে জাহাঙ্গীরকেও আসামি করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, জবানবন্দির তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও নতুন মামলা হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ