
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাত এখনো ভয়াবহ সংকটে রয়েছে। বহুল আলোচিত আর্থিক খাতের প্রতারক প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের লুটপাটের দাগ এখনো এই খাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তিনি যেসব প্রতিষ্ঠানে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেসব প্রতিষ্ঠান এখনো গভীর সংকটে ডুবে আছে। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও দিন দিন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। সামগ্রিকভাবে এনবিএফআই খাতের আর্থিক স্থিতিশীলতা চরম ঝুঁকিতে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের জুন শেষে এনবিএফআই খাতে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৭ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫.৭২ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে প্রায় ৩৬ টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এ হার মার্চে ছিল ৩৫.৩১ শতাংশ এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল।
খেলাপির এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, খাতটির দুরবস্থা এখনো কাটেনি। বরং পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এতে আমানতকারীরা আস্থা হারাচ্ছেন, অনেকেই আমানত তুলে নিচ্ছেন, যার প্রভাব পড়ছে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমেও।
ব্যাংকের তুলনায় এনবিএফআই খাতে খেলাপির হিসাব তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছভাবে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর তদারকির কারণে প্রকৃত খেলাপির তথ্য প্রকাশে প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে, ব্যাংক খাতে আগে অনেক খেলাপি ঋণ গোপন রাখা হতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসছে। ফলে ব্যাংক ও এনবিএফআই উভয় ক্ষেত্রেই খেলাপি ঋণের চাপ বাড়ছে, তবে এনবিএফআই খাতে এর মাত্রা অনেক বেশি।
প্রশান্ত কুমার হালদারের কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ইতিহাসে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তিনি রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এনবিএফআই ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে যান। এখনো সেই অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি। তার তৈরি অনিয়মের বলয় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে। শুধু সরাসরি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নয়, সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এই দুর্নীতির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট এনবিএফআই খাতেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অনেক গ্রাহক ব্যাংকের ওপর আস্থা হারিয়ে এনবিএফআই থেকেও আমানত তুলে নিচ্ছেন। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে আমানত ও ঋণ উভয় ক্ষেত্রে সংকোচন ঘটছে। ব্যবসা কমে যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলো সংকট আরও গভীরভাবে টের পাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে কঠোর আইন প্রয়োগ, ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু কাঠামোগত সংস্কার নয়, এনবিএফআই খাতে নতুন করে আস্থা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারণে গোটা খাত ধসের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেছেন, “সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল নয়। কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো করছে। তবে ৩৫ শতাংশের বেশি ঋণ খেলাপি—এটি অবশ্যই উদ্বেগজনক। তাই খাত পুনর্গঠন এখন জরুরি। ব্যাংক রেজল্যুশন অ্যাক্ট ও প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) শুধু ব্যাংকের জন্য নয়, এনবিএফআই খাতেও কার্যকর করতে হবে।”
বর্তমানে দেশে ৩৫টি এনবিএফআই রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান গুরুতর সমস্যায় আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, এসব প্রতিষ্ঠানের মূল সমস্যা হলো অতিরিক্ত খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি এবং আমানত ফেরত দেওয়ার অক্ষমতা। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এগুলো হলো—এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে, শুধু এই ৯টি প্রতিষ্ঠানের দায়েই এনবিএফআই খাতের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ গোটা খাতকে টেনে নামিয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতি।
বাকি সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করে এক বা দুটি বড় প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে খাতের আস্থা কিছুটা ফিরতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু একীভূতকরণ নয়, কাঠামোগত সংস্কার, আধুনিক নিয়ন্ত্রক কাঠামো ও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ছাড়া এই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এনবিএফআই খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু ঋণ বিতরণ নয়, শিল্প ও অবকাঠামো বিনিয়োগেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাই খাতটির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। নইলে ব্যাংক খাতের পাশাপাশি এনবিএফআই খাতও দেশের সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ