
ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে নির্বাচন প্রস্তুতি, মানবাধিকার রক্ষা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কার কার্যক্রমের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে অতীতের দমনমূলক শাসন থেকে বের হয়ে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে।
ড. ইউনূস তাঁর বক্তব্যে বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করেছে। নির্বাচনকে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার। তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচন কেবলমাত্র ভোটগ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি হবে একটি প্রক্রিয়া, যেখানে নাগরিক আস্থা, স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক বহুমতকে সমানভাবে স্থান দেওয়া হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানান, যেন পতিত স্বৈরশাসক কর্তৃক সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নৃশংসতার চিত্র আন্তর্জাতিক মহলে উন্মোচিত হয়। হাইকমিশনারের নেতৃত্বাধীন দল মাঠপর্যায়ে তদন্ত চালিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয় এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে নানা সুপারিশ করে। তিনি জানান, এসব সুপারিশ জাতীয় সংস্কার কার্যক্রমে ইতোমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ড. ইউনূস স্মরণ করিয়ে দেন যে, গত বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগে বাংলাদেশ গুম সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যোগ দিয়েছিল। বর্তমানে এর বিধান বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। এ বছর বাংলাদেশ জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের ঐচ্ছিক প্রোটোকলেও যোগ দিয়েছে। এর মাধ্যমে একটি স্বাধীন প্রতিরোধমূলক জাতীয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা নির্যাতন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও জানান, মানবাধিকার সুরক্ষায় কারিগরি সহায়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তিন বছর মেয়াদি একটি মিশনের অনুমোদন দিয়েছে। ইতোমধ্যেই মিশনটি মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। এই মিশন বাংলাদেশকে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলতে সহায়তা করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সব ধরনের পদক্ষেপ জনগণের প্রত্যাশারই প্রতিফলন। জনগণ একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী সমাজ গড়তে চায়, যেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ এখন আর কোনো স্বৈরাচারী শাসনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না; বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই, ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণই বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য।
ভাষণের শেষভাগে প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান, বাংলাদেশ যেন এ রূপান্তরমূলক যাত্রায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও সমর্থন পায়। তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অঙ্গীকার নয়, বরং এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্যও জরুরি।
এই ভাষণের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূস শুধু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের রূপরেখাই উপস্থাপন করেননি, বরং অতীতের দমনমূলক শাসন থেকে বেরিয়ে এসে একটি মানবিক, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয়ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরেছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ