
ছবি: সংগৃহীত
চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই–আগস্ট) আমদানি দায় মেটাতে খোলা এলসির (লেটার অব ক্রেডিট) পরিমাণে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই দুই মাসে মোট ১,১৪৮ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ১,০৬০ কোটি ডলারের তুলনায় প্রায় ৮৮ কোটি ডলার বেশি। শতাংশের হিসাবে এই বৃদ্ধির হার ৮.২৮%।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত অর্থবছরের পুরো সময়জুড়ে যেখানে আমদানি বৃদ্ধি ছিল মাত্র ১.৭৫%, সেখানে চলতি অর্থবছরের শুরুতেই এলসি খোলার প্রবৃদ্ধি এক ধরনের ইতিবাচক অর্থনৈতিক সংকেত দিচ্ছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে, যা একদিকে দেশের বাজারে সরবরাহ বাড়াতে সহায়ক হলেও, অন্যদিকে এটি ভোক্তা নির্ভর আমদানির ওপর অর্থনীতির ঝুঁকিপূর্ণ নির্ভরতা বাড়ানোর ইঙ্গিতও দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই–আগস্ট সময়ে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা হয়েছে মোট ৯৯ কোটি ডলার মূল্যের। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯.১৪%। এই শ্রেণির আওতায় প্রধানত খাদ্যপণ্য, ভোজ্যতেল, ভোগ্যচিনি, ওষুধ, দুধজাত পণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় আমদানিসামগ্রী পড়ে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ভোগ্যপণ্যের এলসি বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হলো—বিশ্ববাজারে দাম কিছুটা স্থিতিশীল হওয়া এবং ডলার সংকট প্রশমিত হওয়ায় আমদানিকারকদের নতুন করে অর্ডার দেওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া। পাশাপাশি, চলতি বছরের শুরুতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকায় আমদানিকারকেরা আগের তুলনায় বেশি সক্রিয় হয়েছেন।
অন্যদিকে, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে খুবই সীমিত। প্রথম দুই মাসে এই খাতে এলসি খোলা হয়েছে ২৬ কোটি ৪১ লাখ ডলারের, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ০.৭২% বৃদ্ধি। বিশ্লেষকদের মতে, এ খাতে নিম্ন প্রবৃদ্ধি শিল্প বিনিয়োগের ধীরগতি এবং নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ অনীহারই প্রতিফলন।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখা গেছে মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানিতে। এই খাতে এলসি খোলা কমেছে ১১.৬২%, যা নেমে এসেছে ৬৬ কোটি ৫৯ লাখ ডলারে। এই শ্রেণির পণ্য মূলত উৎপাদনশিল্পের কাঁচামাল ও আধা-প্রসেসড ইনপুটস—যা দেশের শিল্পখাতের গতি নির্ধারণ করে। ফলে এ খাতে পতনকে অনেকেই উৎপাদনক্ষেত্রে সম্ভাব্য মন্থরতার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।
পেট্রোলিয়াম পণ্যের এলসি খোলা বেড়েছে ৩.০৭%, যা ১৪৪ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দামের ওঠানামা ও অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ উৎপাদন চাহিদার ওপর নির্ভর করে এই খাতে এলসি খোলায় তারতম্য দেখা যাচ্ছে।
শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের এলসি খোলা বেড়েছে ৩.৭২%, যা এখন দাঁড়িয়েছে ৪০৩ কোটি ডলারে। বিশ্লেষকদের মতে, এ বৃদ্ধি সামান্য হলেও এটি নির্দেশ করে যে, দেশের তৈরি পোশাক, চামড়া, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারের পথে এগোচ্ছে।
‘অন্যান্য পণ্য’ শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে—১৯.৭৮%। এ খাতে খোলা হয়েছে ৩৬১ কোটি ডলারের এলসি। এই ক্যাটাগরিতে প্রধানত ছোট ও মাঝারি খাতের (এসএমই) বিভিন্ন উৎপাদন সামগ্রী, ইলেকট্রনিকস, যন্ত্রাংশ এবং নিত্যব্যবহার্য আমদানি অন্তর্ভুক্ত।
সম্প্রতি ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক শীর্ষ ২০ ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। বৈঠকে তিনি বলেন, “বর্তমানে ডলারের দর স্থিতিশীল রয়েছে এবং বাজারে তেমন কোনো ডলার সংকট নেই। এই স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকলে পণ্যের দাম আরও কমে আসবে এবং সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।”
গভর্নরের বক্তব্য অনুযায়ী, এলসি খোলার এ প্রবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিতভাবে বজায় থাকলে অর্থনীতির চলমান চাপ কিছুটা হ্রাস পাবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করেছে, অপ্রয়োজনীয় বা বিলাসপণ্যের এলসি খোলায় কঠোর নজরদারি অব্যাহত থাকবে, যেন রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম মনে করেন, “ভোগ্যপণ্যের আমদানি বৃদ্ধি জনগণের চাহিদা মেটাতে ইতিবাচক হলেও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্যে স্থবিরতা মানে হলো নতুন কারখানা স্থাপন ও উৎপাদন সম্প্রসারণে আগ্রহ কম।”
অন্যদিকে, অর্থনীতিবিদ ড. ফাহিম আহমেদ বলেন, “ডলার বাজারে স্বস্তি ফিরে আসায় ব্যবসায়ীরা আবার আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন। তবে আমদানির এই গতি যদি রপ্তানির সঙ্গে সামঞ্জস্য না রাখে, তাহলে কিছু মাস পর পুনরায় চাপ সৃষ্টি হতে পারে।”
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে—চলতি অর্থবছরের শুরুতে আমদানির গতি কিছুটা জোরদার হয়েছে, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামাল খাতে। তবে উৎপাদনমুখী খাতে প্রবৃদ্ধি এখনো আশানুরূপ নয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এলসি খোলার এই গতি যদি সুষমভাবে বজায় থাকে এবং বিনিয়োগ খাত পুনরুজ্জীবিত হয়, তাহলে ২০২৫–২৬ অর্থবছরের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাবার্তা/এসজে