
ছবি: সংগৃহীত
দেশের বাজারে আবারও বাড়ল স্বর্ণের দাম, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং স্থানীয়ভাবে তেজাবি স্বর্ণের (পিওর গোল্ড) দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) নতুন করে দাম সমন্বয় করেছে। শনিবার (৪ অক্টোবর) রাতে বাজুসের জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নতুন মূল্য তালিকা রবিবার (৫ অক্টোবর) থেকে সারা দেশে কার্যকর হবে।
বাজুসের ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভরিপ্রতি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ২ হাজার ১৯২ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৭৬ টাকা। যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বর্ণ বাজারের সর্বোচ্চ দাম হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
বাজুসের ব্যাখ্যায় বলা হয়, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে ঊর্ধ্বমুখী। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের মূল্য পরিবর্তন, এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর আর্থিক নীতিতে অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় স্বর্ণের দাম বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি ও বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিতিশীলতা। এই সব কারণেই স্বর্ণ এখন বিনিয়োগকারীদের কাছে “সেফ হ্যাভেন” বা নিরাপদ বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে।
ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম বাড়ছে, তখন স্থানীয় বাজারেও তা প্রতিফলিত হচ্ছে। বাজুস বলছে, আন্তর্জাতিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি না হয় এবং জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
বাজুসের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী—
-
২২ ক্যারেট স্বর্ণ: ভরিপ্রতি ১,৯৭,৫৭৬ টাকা
-
২১ ক্যারেট স্বর্ণ: ভরিপ্রতি ১,৮৮,৫৯৫ টাকা
-
১৮ ক্যারেট স্বর্ণ: ভরিপ্রতি ১,৬১,৬৫১ টাকা
-
সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ: ভরিপ্রতি ১,৩৪,২৫৩ টাকা
তবে বাজুসের নিয়ম অনুযায়ী, ক্রেতাদের স্বর্ণ ক্রয়ের সময় সরকার নির্ধারিত ৫% ভ্যাট এবং বাজুস নির্ধারিত ৬% মজুরি দিতে হবে। এ ছাড়া গহনার ডিজাইন, কারুকাজ এবং মান অনুযায়ী মজুরির তারতম্য হতে পারে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকা বঙ্গবাজার, নিউ মার্কেট ও বসুন্ধরা গোল্ড হাউজের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, দাম বাড়ার পরও উৎসব ও বিয়ের মৌসুমে স্বর্ণের চাহিদা কমেনি। তবে ক্রেতাদের বড় অংশ এখন গহনা কেনার বদলে পুরনো স্বর্ণ বিক্রি বা রিসাইকেল করে নতুন ডিজাইন তৈরি করছেন।
রাজধানীর একটি দোকানের মালিক বলেন, “স্বর্ণের দাম যতই বাড়ুক, এটা এমন একটি পণ্য যা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করে না। অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে এখন গহনা কিনে রাখছেন।”
অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, টানা দামের উর্ধ্বগতি সাধারণ পরিবারের নাগালে স্বর্ণ কেনা কঠিন করে তুলেছে। আগে যেখানে বিয়ের জন্য সহজে ৫ ভরি স্বর্ণ কেনা যেত, এখন একই বাজেটে সর্বোচ্চ ৩ ভরি কেনা যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে মানুষ নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছে। এছাড়া ডলার সংকট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ হ্রাস এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে আমদানি ব্যয় বাড়ার ফলে স্থানীয় বাজারেও চাপ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. সাইফুর রহমান বলেন, “আমাদের বাজার আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবিত। ডলার এবং জ্বালানি বাজারের প্রতিটি ওঠানামা এখানে স্বর্ণের দামে প্রতিফলিত হয়। তবে স্থানীয় বাজারে নিয়ন্ত্রণ রাখতে বাজুসের নিয়মিত মূল্য সমন্বয় একটি ইতিবাচক দিক।”
স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, আসন্ন শীত মৌসুম ও বিয়ের মৌসুমে চাহিদা আরও বাড়তে পারে, ফলে দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য বাজুস হয়তো আবার সমন্বয় আনতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বর্তমানে প্রতি আউন্স (প্রায় ৩১.১ গ্রাম) স্বর্ণের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ২,৫০০ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে, যা ইতিহাসে অন্যতম সর্বোচ্চ।
দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম যে গতিতে বাড়ছে, তাতে অনেকেই বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণ কেনাকে নিরাপদ মনে করছেন। তবে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য এই মূল্যস্ফীতি একটি বাড়তি চাপ তৈরি করছে। তবুও বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে স্বর্ণের বাজার আপাতত আরও কিছুদিন এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় রাখতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ