
ছবি: সংগৃহীত
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সম্পর্ক রক্ষা এবং বিশেষ দিনগুলোতে শুভেচ্ছা বিনিময় মানবজীবনের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী এমনকি অমুসলিমদের সঙ্গেও শুভেচ্ছা বিনিময়ের নানা রীতি পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে প্রচলিত। তবে মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এসব ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনে শুভেচ্ছা বিনিময়ের যে পদ্ধতিগুলো দেখা যায়, সেগুলোই ইসলামী সংস্কৃতির অংশ হয়ে মুসলিম সমাজে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
ইসলামে শুভ-অশুভের ধারণা
অনেক ধর্ম ও সংস্কৃতিতে শুভ-অশুভের ধারণা প্রচলিত। কোথাও কালো বিড়াল পথ পার হলে অশুভ মনে করা হয়, কোথাও নির্দিষ্ট দিনকে কুলক্ষণ ধরা হয়। কিন্তু ইসলাম এ ধরনের কুসংস্কারকে বাতিল করেছে। ইসলামে অশুভ বা কুলক্ষণ বলে কিছু নেই। তবে শুভ অর্থে রয়েছে কল্যাণের প্রত্যাশা।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, “ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি কিংবা কুলক্ষণ বলে কিছুই নেই। তবে ফাল অর্থাৎ শুভ লক্ষণ আমাকে আনন্দিত করে।” সাহাবিরা জানতে চাইলেন, ফাল বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? নবীজি (সা.) উত্তরে বললেন, “উত্তম বাক্য।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭৭৬)।
অর্থাৎ সুন্দর শব্দ বা মধুর বাক্য শুনে মনে মনে কল্যাণের আশা করা ইসলামে প্রশংসনীয়। এখান থেকেই বোঝা যায়, ইসলামে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মূল উদ্দেশ্য হলো—পরস্পরের মঙ্গল কামনা।
ইসলামী শুভেচ্ছার প্রধান রীতিগুলো
১. সালাম (তাহিয়্যা)
মুসলমানদের মৌলিক শুভেচ্ছা হলো সালাম। পবিত্র কোরআনে সালামকে ‘তাহিয়্যা’ বলা হয়েছে। অসংখ্য আয়াতে এসেছে, “সালামুন আলাইকুম”—তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। নবীজি (সা.)-এর যুগ থেকেই মুসলমানরা সাক্ষাতে বলে আসছেন, “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।” উত্তরে বলা হয়, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।”
আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন, “আর যখন তোমাদেরকে অভিবাদন করা হয়, তখন তোমরাও তার চাইতে উত্তম অভিবাদন করো অথবা অন্তত সমতুল্য উত্তর দাও।” (সুরা নিসা, আয়াত : ৮৬)। এভাবেই সালাম মুসলিম সংস্কৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২. মুসাফাহা (হাত মেলানো)
পরস্পরের হাতে হাত মিলিয়ে শুভেচ্ছা জানানোকে মুসাফাহা বলা হয়। সর্বপ্রথম ইয়েমেনের মুসলমানরা এ রীতি চালু করেছিলেন। রাসুল (সা.) বলেন, “যখন দুই মুমিন সাক্ষাৎ করে মুসাফাহা করে, তখন তারা পৃথক হওয়ার আগেই তাদের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (তিরমিজি, হাদিস : ২৭২৭)।
৩. মুআনাকা (কোলাকুলি)
দূর সফর শেষে সাহাবিরা যখন একে অপরের সঙ্গে দেখা করতেন, তখন কোলাকুলি করতেন। এমনকি জাফর ইবনে আবি তালিব (রা.) হাবশা থেকে মদিনায় ফিরে আসলে নবীজি (সা.) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং কপালে চুমু দেন। তবে কিছু আলেম আশঙ্কা করেছেন, কোলাকুলি বা চুমু খাওয়ার মধ্যে ফিতনার সম্ভাবনা থাকতে পারে। তাই মূলত মুসাফাহাই অধিক প্রাধান্য পেয়েছে।
৪. তাকবিল (চুমু খাওয়া)
কিছু হাদিসে কপালে বা চোখের মাঝে চুমু খাওয়ার কথা এসেছে। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এবং ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) ফিতনার আশঙ্কায় একে নিরুৎসাহিত করেছেন। রাসুল (সা.)-এর এক হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—চুমু খাওয়া বা কোলাকুলি নয়, বরং মুসাফাহা করা উচিত। (তিরমিজি, হাদিস : ২৭২৮)।
৫. তারহিব ও তাহলিল
আরব সমাজে আগন্তুককে স্বাগত জানানোর জন্য বলা হয় “মারহাবা”—অর্থাৎ স্বাগতম। অনুরূপভাবে “আহলান সাহলান” বলা হয়, যার অর্থ—আপনাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত। সময় ভেদে বলা যায়, “সাবাহাল খাইর” (শুভ সকাল), “মাসায়াল খাইর” (শুভ সন্ধ্যা)। এও ইসলামের সংস্কৃতির অংশ।
৬. তাবাসসুম (মুচকি হাসি)
রাসুল (সা.) বলেন, “তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও সদকা।” (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৬২)। অর্থাৎ কেবল মুখের হাসি দিয়েও শুভেচ্ছা জানানো যায়, যা ইসলামে একটি কল্যাণমূলক কাজ হিসেবে গণ্য।
৭. তাহনিয়া (অভিনন্দন ও শুভকামনা)
কারো সাফল্য বা বিশেষ অর্জনে শুভেচ্ছা জানানোও ইসলামী রীতি। যেমন নব দম্পতির জন্য নবীজি (সা.) দোয়া করেছেন—“আল্লাহ তোমাদের জন্য বরকতময় করুন, তোমাদের মিলনে কল্যাণ দান করুন।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৯০৫)।
অমুসলিমদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়
ইসলাম মানবিকতার ধর্ম। অমুসলিমদের সঙ্গেও সৌজন্য বিনিময় বৈধ। তবে সব পদ্ধতি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
-
সালাম কেবল মুসলিমদের জন্য: সালাম ইসলামী আকিদার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই অমুসলিমদের উদ্দেশে আগে সালাম দেওয়া অনুমোদিত নয়। তবে তারা যদি সালাম দেয়, তখন জবাবে বলা যাবে “ওয়া আলাইকুম।”
-
মুসাফাহা: হানাফি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাবে অপ্রয়োজনে অমুসলিমদের সঙ্গে মুসাফাহা করা মাকরুহ। তবে তারা আগে হাত বাড়ালে সাড়া দেওয়া বৈধ।
-
মালিকি মাজহাব: তাদের মতে, অমুসলিমদের সঙ্গে মুসাফাহা সর্বাবস্থায় হারাম।
-
আচরণে উৎকৃষ্টতা: নবীজি (সা.) বলেছেন, “মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো।” (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৮৭)। অর্থাৎ অমুসলিমদের প্রতিও ভালো ব্যবহার করা ইসলামের শিক্ষা।
ইসলামে শুভেচ্ছার মূল ভিত্তি হলো—মহান আল্লাহর বরকত, দয়া এবং শান্তির প্রার্থনা। সালাম, মুসাফাহা, মুচকি হাসি, দোয়া কিংবা অভিনন্দন—সবকিছুই পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও কল্যাণ কামনার প্রকাশ।
অতএব, মুসলমানরা যখন একে অপরকে সালাম দিয়ে অভিবাদন জানায় বা হাত মেলায়, তখন শুধু সৌজন্য নয়, বরং এটি একটি ইবাদতও বটে। আবার অমুসলিমদের প্রতিও শিষ্টাচার রক্ষা ও উত্তম আচরণ ইসলামেরই শিক্ষা। ইসলামের এই রীতি ও সংস্কৃতি মানব সমাজে শান্তি, ভালোবাসা ও সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠার এক অনন্য মাধ্যম।
বাংলাবার্তা/এমএইচ