
ছবি: সংগৃহীত
মানবজীবনে সম্মান ও মর্যাদা এমন এক মূল্যবান সম্পদ, যা কোনো ধন-সম্পদ, ক্ষমতা বা বংশীয় পরিচয়ে পাওয়া যায় না। বরং একমাত্র মহান আল্লাহই তাঁর বান্দাকে সম্মানিত বা লাঞ্ছিত করেন। দুনিয়ার জীবনে যাকে আল্লাহ সম্মানিত করেন, আখেরাতেও তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহর কাছে মর্যাদা লাভের কিছু নির্দিষ্ট আমল আছে, যা কোরআন, হাদিস ও ইসলামি মনীষীদের বাণীতে সুস্পষ্টভাবে আলোচিত হয়েছে। এসব আমল শুধু ব্যক্তিকে আল্লাহর নৈকট্যেই পৌঁছে দেয় না, বরং সমাজেও তাকে সম্মানিত করে তোলে। নিচে আল্লাহর কাছে মর্যাদা বৃদ্ধির ১০টি বিশেষ আমল বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।
১. তাকওয়া অবলম্বন করা
তাকওয়া বা আল্লাহভীরুতা এমন এক গুণ, যা মানুষকে অন্য সব গুণের ওপরে স্থান দেয়। আল্লাহ তাআলা কোরআনে ঘোষণা করেছেন—“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু।” (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১৩)। তাকওয়াধারী বান্দা আল্লাহর ভয়ে গোনাহ থেকে বিরত থাকে, হালাল-হারামের পার্থক্য করে চলে, এবং নেক আমলের প্রতি আগ্রহী হয়। সমাজে তাকওয়াধারী মানুষ সবসময় সম্মানিত হয় এবং আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
২. দ্বিনি জ্ঞান অর্জন
ইলম বা জ্ঞান অর্জন শুধু দুনিয়ার উন্নতির জন্য নয়, বরং আখেরাতের মর্যাদা বৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম। যারা দ্বিনি জ্ঞান অর্জন করে, আল্লাহ তাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দান করেন। কোরআনে বলা হয়েছে—“যারা ঈমান এনেছে এবং জ্ঞান অর্জন করেছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা উচ্চ করবেন।” (সুরা মুজাদালাহ, আয়াত : ১১)। হাদিসে এসেছে, একজন আলেমের মর্যাদা একজন সাধারণ আবেদ বা ইবাদতকারীর তুলনায় অনেক বেশি। কারণ জ্ঞান মানুষকে পথ দেখায় এবং সমাজে আলোর দিশা দেয়।
৩. তাহাজ্জুদ সালাত
রাতের নিস্তব্ধ সময়ে তাহাজ্জুদ আদায় করা আল্লাহর কাছে বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে। কোরআনে বলা হয়েছে—“রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়বে, যা তোমার জন্য অতিরিক্ত ইবাদত। হয়তো তোমার প্রতিপালক তোমাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন।” (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭৯)। যারা তাহাজ্জুদ পড়ে, তাদের জন্য আখেরাতে বিশেষ স্থান নির্ধারিত থাকবে। নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম এ সালাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন।
৪. সন্তানের দোয়া মাতা-পিতার জন্য
পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও সন্তানের দোয়া তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। হাদিসে এসেছে—আল্লাহ জান্নাতে কোনো নেক বান্দার মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন। তখন সে অবাক হয়ে বলবে—হে আল্লাহ! আমার মর্যাদা কেন বেড়ে গেল? তখন আল্লাহ বলবেন—“তোমার সন্তানের দোয়ার কারণে।” (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ৩৬৬০)। এ থেকেই বোঝা যায়, পিতা-মাতার মর্যাদা বৃদ্ধিতে সন্তানের নেক আমল কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
৫. কোরআনের ধারক-বাহক হওয়া
যারা কোরআন শিখে, হিফজ করে এবং আমল করে, তারা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করবে। কিয়ামতের দিন কোরআন তাদের জন্য সুপারিশ করবে। এক হাদিসে এসেছে—কোরআন পাঠককে বলা হবে, পড়ো এবং ওপরে উঠতে থাকো। প্রতিটি আয়াতের বিনিময়ে তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৯১৫)। কোরআনের সঙ্গে মজবুত সম্পর্ক মানুষকে আল্লাহর বন্ধুতে পরিণত করে।
৬. নবীজির প্রতি দরুদ
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করা বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধির অন্যতম উপায়। নবী (সা.) বলেছেন—“যে আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার ওপর ১০ বার রহমত বর্ষণ করবেন, ১০টি গুনাহ মাফ করবেন এবং ১০ গুণ মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।” (নাসাঈ, হাদিস : ১২৯৭)। তাই মুসলমানদের উচিত বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা।
৭. কল্যাণকর কথা বলা
ভালো ও কল্যাণকর কথা আল্লাহর কাছে মর্যাদা বাড়ায়। হাদিসে এসেছে—“কখনো বান্দা এমন একটি কথা বলে ফেলে, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে এবং তার মর্যাদা বেড়ে যায়। আবার কখনো এমন একটি কথা বলে, যা আল্লাহর গজব ডেকে আনে এবং সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়।” (বুখারি, হাদিস : ৬৪৭৮)। এ জন্য সর্বদা ভেবে-চিন্তে কথা বলা উচিত।
৮. ইসলামে দাড়ি-চুল পাকা হওয়া
চুল-দাড়ি সাদা হওয়া ইসলামে মর্যাদার প্রতীক। নবী (সা.) বলেছেন—“মুসলমানের চুল পাকা হলে তা কিয়ামতের দিন নূর হবে। প্রতিটি সাদা চুলের বিনিময়ে আল্লাহ একটি নেকি লিখবেন, একটি গুনাহ মাফ করবেন এবং মর্যাদা বাড়াবেন।” (ইবনু হিব্বান, হাদিস : ২৯৮৫)। অর্থাৎ বয়সজনিত চিহ্নও মুসলিমের জন্য আল্লাহর রহমতের মাধ্যম হতে পারে।
৯. গোপন আমল করা
গোপনে ইবাদত ও সৎকাজ করা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। হাদিসে এসেছে—যে ব্যক্তি গোপনে দান করে, যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে অশ্রু ঝরায়, তাদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বড়। (বুখারি, হাদিস : ৬৬০)। গোপন আমল বান্দার আন্তরিকতার পরিচায়ক এবং আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের মাধ্যম।
১০. ঈমান ও নেক আমল
অবশেষে মর্যাদা বৃদ্ধির মূল শর্ত হলো ঈমান ও নেক আমল। আল্লাহ বলেন—“যে ব্যক্তি ঈমানদার হয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হবে এবং সৎকর্ম করবে, তার জন্য আছে উচ্চ মর্যাদা ও স্থায়ী জান্নাত।” (সুরা ত্ব-হা, আয়াত : ৭৫-৭৬)। প্রকৃত সম্মান কেবল ঈমানদার ও নেককারদের জন্য নির্ধারিত।
মর্যাদা কোনো পার্থিব উপাধি নয়, বরং এটি আল্লাহর দেওয়া এক বিশেষ অনুগ্রহ। দুনিয়ার সম্মান অস্থায়ী হলেও আল্লাহর কাছে মর্যাদা চিরস্থায়ী। তাকওয়া, জ্ঞান, তাহাজ্জুদ, দরুদ, কোরআন শিক্ষা, পিতামাতার সেবা, গোপন আমল এবং ঈমান—এসবই হলো সেই বিশেষ মাধ্যম, যার দ্বারা বান্দা আল্লাহর কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এসব আমল করার তাওফিক দিন এবং আখেরাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ