
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতির ঘোষণা দিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন আজ বুধবার নির্বাচন কমিশন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, ইসি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি আগেভাগেই এগিয়ে নিচ্ছে। সব ধরনের চ্যালেঞ্জ ও জটিলতা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়েই অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনই তাঁদের মূল লক্ষ্য।
সিইসি বলেন, ‘আমরা অনেক আগেই প্রস্তুতি শুরু করেছি। এখন নির্বাচনের জন্য মানসিকভাবে এবং কাঠামোগতভাবে প্রস্তুত হচ্ছি।’ তিনি আরও জানান, নির্বাচনের পূর্ব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তি, প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম সংগ্রহ ও নির্বাচন রোডম্যাপ তৈরি—সবই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে চায় কমিশন।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা ও ইসির প্রস্তুতি
সিইসি জানান, সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন আয়োজন বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ইসিকে জানিয়ে দিয়েছেন যে ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগেই, রমজানের আগেই নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। সিইসি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আমরা শিগগিরই প্রধান উপদেষ্টার আনুষ্ঠানিক চিঠি পাব। সেই অনুযায়ী আমরা চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করব।”
ভোটার তালিকা ও আইন সংশোধনের তথ্য
সিইসি আরও জানান, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যারা ডিসেম্বরের মধ্যে ১৮ বছর পূর্ণ করবেন, তাদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ দিতে ভোটার সংক্রান্ত আইন সংশোধন করা হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণ ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় ইসি।
ভোটার নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, নির্বাচনী সামগ্রী ক্রয়সহ সব ধরনের লজিস্টিক ও প্রশাসনিক কাজ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই শেষ করার লক্ষ্যে কাজ করছে ইসি।
তফসিল ও রোডম্যাপ: ডিসেম্বরের শুরুতেই ঘোষণা
নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ প্রস্তুতের অগ্রগতি সম্পর্কে সিইসি বলেন, “তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতিও চলছে। আশা করছি, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তফসিল ঘোষণা করা যাবে।” তিনি বলেন, রোডম্যাপ ধাপে ধাপে প্রকাশ করা হবে। এ সময় তিনি ইঙ্গিত দেন যে রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, সংবাদমাধ্যমসহ সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করা হবে।
সিইসি বলেন, “আমরা চাই সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে। মিডিয়ার অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা আমাদের সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডারদের একজন।”
সাংবাদিকদের কেন্দ্রে প্রবেশ ও নীতিমালার সংস্কার
সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ সংক্রান্ত প্রশ্নে সিইসি বলেন, “আমরা সাংবাদিকদেরকে সহযোগী হিসেবে দেখি, কখনোই প্রতিপক্ষ হিসেবে না। সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ বিবেচনায় রেখে আমরা নীতিমালা সংশোধনের চিন্তাভাবনা করছি। শুধু সাংবাদিকতা নিয়ে নয়, নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়েও আপনাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করব।”
সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও নতুন দল নিবন্ধন
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নে সিইসি জানান, ইতোমধ্যে একটি খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। আপত্তি ও শুনানির মাধ্যমে চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করা হবে, যা ‘বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষভাবে’ পরিচালিত হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।
এছাড়া নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে সিইসি বলেন, “আমরা যাচাই-বাছাই, স্ক্রুটিনি ও আপত্তি গ্রহণের কাজ করছি। এই প্রক্রিয়া সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে।”
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা
সিইসি বলেন, “আমাদের একটি বড় লক্ষ্য হচ্ছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। এজন্য জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, কোনো দলীয় পক্ষপাত নয়, নিরপেক্ষভাবে পেশাদার দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এবার রাজনৈতিক চাপ নেই। বরং যারা নিয়মের বাইরে কাজ করবে, তাদের পেশাগত ও সামাজিকভাবে জবাবদিহি করতে হবে—মানুষ, রাষ্ট্র এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে।”
ভোটার আস্থা ফেরানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ
সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভোটারদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা। অতীতে নানা কারণে ভোটাররা নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এটি শুধুমাত্র তাদের দোষ নয়, নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা হারানোর ফল।’
তাই কমিশনের অন্যতম লক্ষ্য হলো একটি সর্বজনগ্রাহ্য, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন, যাতে সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ অংশ নিতে আগ্রহী হয়। এই লক্ষ্যে জনসচেতনতামূলক ব্যাপক ক্যাম্পেইন চালানোর ঘোষণা দেন সিইসি।
এআই মিসইউজ ও ডিজিটাল ভুয়া প্রচারণা: নতুন চ্যালেঞ্জ
নির্বাচন কমিশনের জন্য সবচেয়ে নতুন ও জটিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে এআই-এর (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) অপব্যবহার এবং ডিজিটাল মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর কথা বলেন সিইসি। তিনি বলেন, “প্রতিদিনই ভুল তথ্য, ভিডিও ও মিথ্যা প্রচারণা ছড়ানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বড় সমস্যা না হলেও ডিজিটাল দিক থেকে এটি আমাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
রিটার্নিং অফিসারদের নিরপেক্ষতা
গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারদের ভূমিকা নিয়ে উঠা প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, “আমরা রিটার্নিং অফিসারদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবছি। যারা আগে পক্ষপাত দেখিয়েছেন, এবার যেন তারা নিরপেক্ষ থাকেন তা নিশ্চিত করতে কমিশন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এবার কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।”
রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও নির্বাচন ব্যবস্থা
আওয়ামী লীগের সদস্যদের নির্বাচন অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দল হিসেবে তারা অংশ নিতে পারবে না। তবে ব্যক্তিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে পারবেন এবং সমর্থকেরা ভোট দিতে পারবেন। আইন অনুযায়ী আমরা কাজ করব।”
একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনই মূল লক্ষ্য
সিইসি নাসির উদ্দিন স্পষ্টভাবে বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য একটাই— একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ এবং জনগণের আস্থার নির্বাচন আয়োজন করা। জনগণকে ভোটকেন্দ্রে ফিরিয়ে আনাই আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ। রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে পুনরায় আস্থাভাজন করতে এই নির্বাচনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।”
নির্বাচন কমিশনের এই ধারাবাহিক প্রস্তুতি ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং সাধারণ নাগরিক—সবার সমন্বিত সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করছে কমিশন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ