
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই দেশের সব পুলিশ সুপার (এসপি) এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) লটারির মাধ্যমে বদলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সিদ্ধান্তের লক্ষ্য হচ্ছে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা। এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
বুধবার (৬ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শেষে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। বৈঠকে নির্বাচনকেন্দ্রিক লজিস্টিক সহায়তা, মাঠ প্রশাসনের করণীয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বয় এবং প্রার্থীদের প্রতি নিরপেক্ষ আচরণ নিশ্চিতে নানা পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন উপদেষ্টা।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, "গতকাল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের মাধ্যমে নির্বাচন প্রস্তুতির সূচনা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় আজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমাদের এই বৈঠক। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই আমাদের দায়িত্ব বাড়ছে। প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে এবার আমরা ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছি—এসপি ও ওসি পদে বদলি হবে লটারি করে, সবার সামনে, মিডিয়ার উপস্থিতিতে।"
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং ওসিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে বহু নির্বাচনে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পছন্দের কর্মকর্তাকে তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাখতে চাপ সৃষ্টি করে। এবার সেই সুযোগ থাকবে না। কারণ, লটারির মাধ্যমে বদলি হলে কোনো পক্ষই আগে থেকে জানবে না কে কোথায় যাবে।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লটারির মাধ্যমে শুধুমাত্র এসপি এবং ওসিদের বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওসিদের ক্ষেত্রে ডিভিশন অনুযায়ী লটারি হবে, অর্থাৎ বিভাগভিত্তিক তালিকা তৈরি করে সেখানে লটারি পরিচালিত হবে যাতে একটি জেলার ওসি অন্য জেলার সমপর্যায়ের থানায় চলে যেতে পারেন। ডিসিদের বদলির বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকায় তারা কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটি তারা জানাবে। তবে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও একইভাবে লটারির পথ বেছে নেবে।
তিনি বলেন, "লটারি হবে তফসিল ঘোষণার কিছুদিন আগে। কারণ একবার তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে, এসব বদলির দায়িত্ব চলে যায় নির্বাচন কমিশনের হাতে। কমিশন তখন প্রয়োজন মনে করলে পুনরায় বদলির সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।"
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এই উদ্যোগকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, এটি হবে একটি সিস্টেমেটিক ও ট্রান্সপারেন্ট প্রক্রিয়া। এতে রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে। সেই সঙ্গে জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে যে প্রশাসন কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করছে না।
তিনি বলেন, "নির্বাচনের পরিবেশ স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য রাখতে গেলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হবে। আর এই বাহিনীগুলোর সদস্যদের নিয়োগ ও অবস্থান যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই এ ব্যবস্থা।"
অতীতের বিভিন্ন নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, "এর আগেও অনেকবার নির্বাচনের আগে কর্মকর্তাদের বদলি করা হলেও তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে—কে কাকে বদলি করল, কেন করল, কার ইচ্ছায় করল—এসব প্রশ্ন উঠেছে। এবার আমরা সে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসে একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি গ্রহণ করেছি।"
সূত্র মতে, লটারি করার জন্য একটি স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করা হবে, যাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত থাকবেন। একটি বড় পর্দায় প্রত্যেক কর্মকর্তার নাম ও তাদের সম্ভাব্য পোস্টিং এলাকা তুলে ধরা হবে। এরপর লটারির মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন পোস্টিং নির্ধারিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর আগেই জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে, যেন রমজানের আগেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হয়। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই প্রশাসনিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি বলেন, "আমরা চাই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় করে যথাসময়ে সব দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু তার আগে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, যাতে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা বা দ্বিধার জায়গা না থাকে।"
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে বদলির জন্য সরকারের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিভিন্ন মহল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ, যা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। তবে এই প্রক্রিয়া কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ