
ছবি: সংগৃহীত
গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির দিনটি ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে বাংলাদেশের জন্য। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া ছাত্র-জনতার জনআন্দোলনের সাফল্যের পরিণতি হিসেবে আজ (মঙ্গলবার) প্রকাশ করা হলো দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। এতে জুলাই আন্দোলনের শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যা আন্দোলনের দাবির এক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার স্বীকৃতি।
ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আয়োজিত ‘জুলাই পুনর্জাগরণ’ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সুশাসন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানুষের মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রের শুরুতেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মরণ এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার সংগ্রামকে স্মরণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের দুর্বলতা ও তার অপব্যবহারের কারণে স্বাধীনতার পরবর্তী সময় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল শাসনব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পথ সুগম হয়েছিল। এরপর ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক শাসনাবস্থা পতিত হয়ে পুনরায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঘোষণাপত্রে বর্ণিত হয়েছে, গত ১৬ বছর ধরে দেশের ওপর ছায়া ফেলেছে ফ্যাসিবাদী ও একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। অবৈধভাবে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে নানা নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। সরকারের দুঃশাসন, গুম-খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণসহ একদলীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ধ্বংস করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র, শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ষোল বছর ধরে অবিরাম গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চালিয়ে আসলেও জেল-জুলুম, হামলা-মামলা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে। দেশের মানুষের ন্যায়সংগত বিদেশী প্রভুত্ব ও শোষণ বিরোধী আন্দোলনকে সরকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়, যা দেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের এক যুগান্তকারী পরিণতি নিয়ে আসে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করে। ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করে এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর অবৈধ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।
এরপর সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এবং সুপ্রীম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারের অধীনে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থাকে বিলোপ করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা হয়।
ঘোষণাপত্রে দেশের জনগণ সুশাসন, সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন, মানবাধিকার রক্ষা, দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেছে। তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা অনুযায়ী মূল্যবোধসম্পন্ন, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে জুলাই গনঅভ্যুত্থানের শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণা, শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের জন্য আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাসহ দেশের জন্য সর্বাত্মক শান্তি, সমৃদ্ধি ও প্রগতির জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘোষণাপত্র দেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো পুনর্গঠনে একটি নতুন যুগের সূচনা। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক সংকট ও দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে যেসব মূল্যবোধ ক্ষুণ্ন হয়েছে, তা পুনরুদ্ধারে এই ঘোষণা যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।
রাজনৈতিক নেতা ও সামাজিক সংগঠকরা বলেন, “জুলাই ঘোষণাপত্র দেশের ইতিহাসে গণতন্ত্রের বিজয়ের ঘোষণা এবং এটি দেশের সকল মানুষের জন্য ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তিতে নতুন সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি।”
ঘোষণাপত্র স্পষ্ট করেছে, বাংলাদেশ একটি মুক্ত, গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার সম্মত এবং বৈষম্য মুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে। সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্জিত এই গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে দেশের সকল নাগরিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমানাধিকার পাবে।
আগামী দিনে সুশাসন, ন্যায় ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে গৌরবোজ্জ্বল একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণাপত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।
এই ঘোষণা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত হবে। এর মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি ন্যায়পরায়ণ, উন্নত ও মানবিক সমাজ গড়ার পাথেয় পাবে। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এটি একটি ঐতিহাসিক সংকল্প।
ঘোষণাপত্রের ২৮ দফায় যা যা আছে
১। যেহেতু উপনিবেশ বিরোধী লড়াইয়ের সুদীর্ঘকালের ধারাবাহিকতায় এই ভূখণ্ডের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল;
২। যেহেতু, বাংলাদেশের আপামর জনগণ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিবৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে।
৩। যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রনয়ন পদ্ধতি, এর কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ করেছিল।
৪। যেহেতু স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে বাকশালের নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে এবং মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে, যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রবর্তনের পথ সুগম হয়।
৫। যেহেতু আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় বছর ছাত্র-জনতার অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং ১৯৯১ইং সনে পুনরায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
৬। যেহেতু দেশী-বিদেশী চক্রান্তে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ১/১১ -এর ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা, আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করা হয়।
৭। যেহেতু গত দীর্ঘ ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এবং একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অতি উগ্র বাসনা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে সংবিধানের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক পরিবর্তন করা হয় এবং যার ফলে একদলীয় একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়;
৮। যেহেতু শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, গুম-খুন, আইন-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধ্বংস করে;
৯। যেহেতু, হাসিনা সরকারের আমলে তারই নেতৃত্বে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক, ও মানবাধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে;
১০। যেহেতু, তথাকথিত উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী নেতৃত্বে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বিগত পতিত দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ ও এর অমিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং এর পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করে;
১১। যেহেতু শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ গত প্রায় ষোল বছর যাবত নিরন্তর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করে জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়;
১২। যেহেতু বাংলাদেশে বিদেশী রাষ্ট্রের অন্যায় প্রভুত্ব, শোষণ ও খবরদারিত্বের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে বহিঃশক্তির তাবেদার আওয়ামী লীগ সরকার নিষ্ঠুর শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে;
১৩। যেহেতু অবৈধভাবে ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি প্রহসনের নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন) এদেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে;
১৪। যেহেতু, আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সরকারী চাকুরীতে একচেটিয়া দলীয় নিয়োগ ও কোটাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে ছাত্র, চাকুরী প্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম হয়;
১৫। যেহেতু বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ওপর চরম নিপীড়নের ফলে দীর্ঘদিন ধরে জনরোষের সৃষ্টি হয় এবং জনগণ সকল বৈধ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই চালিয়ে যায়;
১৬। যেহেতু, সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিলোপ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন, বর্বর অত্যাচার ও মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ড চালানো হয়, যার ফলে সারা দেশে দল-মত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়;
১৭। যেহেতু ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী, শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ যোগদান করে এবং আওয়ামী ফ্যাসিবাদী বাহিনী রাজপথে নারী-শিশুসহ প্রায় এক হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, অগনিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করে এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করে;
১৮। যেহেতু, অবৈধ শেখ হাসিনা সরকারের পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জনগণ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে, পরবর্তী সময়ে ৫ আগস্ট ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ পরিচালনা করে এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনরত সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতা তথা সর্বস্তরের সকল শ্রেণী, পেশার আপামর জনসাধারণের তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণভবনমুখী জনতার উত্তাল যাত্রার মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়;
১৯। যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবেলায় গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রত্যয় ও প্রয়োগ রাজনৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত, বৈধ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত;
২০। যেহেতু জনগণের দাবি অনুযায়ী এরপর অবৈধ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রীম কোর্টের মতামতের আলোকে সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়;
২১। যেহেতু, বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের ফ্যাসিবাদবিরোধী তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়;
২২। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে;
২৩। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ বিগত ষোল বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম কালে এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালীন সময়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ ও সকল ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধসমূহের দ্রুত উপযুক্ত বিচারের দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে;
২৪। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গনঅভ্যুত্থানের সকল শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করে শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্রজনতাকে প্রয়োজনীয় সকল আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।
২৫। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ যুক্তিসঙ্গত সময়ে আয়োজিতব্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।
২৬। সেহেতু বাংলাদেশের জনগণ এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছে যে একটি পরিবেশ ও জলবায়ু সহিষ্ণু অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষিত হবে।
২৭। বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।
২৮। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ