
ছবি: সংগৃহীত
আজকের দিনটি ইতিহাসে শুধু একটি তারিখ নয়, বরং একটি প্রতিজ্ঞার প্রতিচ্ছবি—একটি নতুন দিনের সূচনার দিন। ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন অতীতের সংগ্রাম ও ভবিষ্যতের দায়িত্বের কথা।
সন্ধ্যায় জাতীয় সম্প্রচারে প্রচারিত এই ভিডিওবার্তায় তিনি বলেন, "আমরা আজ অতীত স্মরণ করতে একত্র হইনি, বরং একটি শপথ নিতে এসেছি—আমরা কোনো নিপীড়নের কাছে মাথা নোয়াব না। আমরা প্রতিষ্ঠা করব এমন একটি রাষ্ট্র, যা হবে জবাবদিহিমূলক, মানবিক, গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যহীন।"
প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য একটি প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তিনি বলেছেন, এই রাষ্ট্র এমন হবে, যেখানে প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি নীতিনির্ধারণ শুধু জনগণের কল্যাণে নিবেদিত থাকবে।
অধ্যাপক ইউনূসের ভাষণে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানকে তিনি একটি নতুন ইতিহাসের সূচক হিসেবে বর্ণনা করেন। তার ভাষায়, "৫ আগস্ট শুধুমাত্র একটি দিবস নয়, এটি একটি গণজাগরণ, একটি প্রতিজ্ঞা এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জাতির পুনর্জন্মের দিন।"
তিনি বলেন, “আজ আমরা স্মরণ করি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই মহাবীরদের, যাদের আত্মত্যাগে এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার, কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। মানুষ আজও বঞ্চিত। আর সেই বঞ্চনার দায় বহন করতে হয় আমাদেরকেই।”
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তার বক্তব্যে বিগত দেড় দশকের স্বৈরাচারী শাসনের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, দীর্ঘ ষোলো বছর ধরে দেশের প্রায় প্রতিটি খাতে এক ধরনের মাফিয়াতন্ত্র গড়ে তোলা হয়েছিল, যার মাধ্যমে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করা হয়। এই শ্রেণির সদস্যরা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যম, শিক্ষা, এমনকি অর্থনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করত।
"এই সুবিধাভোগী গোষ্ঠী আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে স্বৈরাচারী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছে," বলেন অধ্যাপক ইউনূস। "যারা সরকারের সমালোচনা করেছে, জনগণের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, তাদের হয় গুম করা হয়েছে, নয়তো কারাবন্দী করা হয়েছে।"
তিনি ২০২৪ সালের জুলাইয়ে হওয়া গণ-আন্দোলনের প্রসঙ্গে বলেন, এটি ছিল ষোলো বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের অভূতপূর্ব বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেন, "ছাত্রসমাজ, তরুণ প্রজন্ম এবং সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারা সমস্বরে বলেছিল—এবার ফ্যাসিবাদকে যেতে হবে।"
ড. ইউনূস আরো বলেন, তৎকালীন সরকার জনরোষ দমাতে গিয়ে ভয়াবহ দমন-পীড়ন চালায়। তারা নির্বিচারে গুলি চালায়, ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলনের খবর আড়াল করতে চায়, এমনকি গুলিবিদ্ধ আহতদের হাসপাতালে ভর্তি নিতেও বাধা দেয়। তার ভাষায়, “হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন আহতদের চিকিৎসা না দেওয়া হয়। এর ফলে বহু মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে, পঙ্গু হয়ে গেছে।”
ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানান তাদের প্রতি, যারা গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন বা আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। "আপনাদের আত্মত্যাগের ঋণ জাতি কখনো শোধ করতে পারবে না," বলেন তিনি।
তিনি জানান, সরকার ইতোমধ্যে শহীদ ও আহতদের কল্যাণে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৮৩৬টি শহীদ পরিবারের মধ্যে ৭৭৫টি পরিবারকে মোট ৯৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও মাসিক ভাতা প্রদান। এছাড়াও ১৩ হাজার ৮০০ জন আহত ‘জুলাই যোদ্ধা’কে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মোট ১৫৩ কোটি ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও জানান, গুরুতর আহত ৭৮ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তুরস্ক ও রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। এতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
অধ্যাপক ইউনূস তার বক্তব্যের শেষাংশে বলেন, “জুলাইয়ের মহানায়কদের আত্মত্যাগ তখনই সার্থক হবে, যখন এই দেশকে আমরা একটি সত্যিকারের কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারব—যেখানে থাকবে না কোনো বৈষম্য, থাকবে না নিপীড়ন। থাকবে শুধু ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও মানুষের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার।”
তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান, যেন সবাই মিলে এই নতুন বাংলাদেশের নির্মাণে অংশগ্রহণ করে। তার ভাষায়, “এই শপথ আমাদের সবার। কারণ, মানবিক, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়—এটি সমগ্র জাতির সংগ্রাম।”
এই ভাষণের মাধ্যমে জাতিকে একটি নতুন দিকনির্দেশনা দিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তার বক্তব্যে যেমন আছে অতীতের বেদনার স্মৃতি, তেমনি আছে একটি সুস্থ, সুশাসিত এবং মানবিক রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ